প্রকাশের তারিখ: বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক:
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে শুনানির দ্বিতীয় দিনে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রশ্ন তুলেছেন—“দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসে, তাহলে কি সংসদের ক্ষমতা খর্ব হবে না?”
বুধবার (২২ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চে এ মন্তব্য করেন তিনি।
🔶 আদালতের পর্যবেক্ষণ
প্রধান বিচারপতি বলেন, এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত মামলাটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তাই আপিল বিভাগে এ মামলার শুনানি চলাকালীন অন্য কোনো মামলার শুনানি হবে না।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিষয়টি শুধু সংবিধান সংশোধনের প্রশ্ন নয়—এটি সংসদীয় ক্ষমতার ভারসাম্য ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্থিতিশীলতার সঙ্গেও জড়িত।
🔶 সুজনের আবেদন ও আইনজীবীর যুক্তি
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। তিনি জানান, হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগ পর্যন্ত মোট ১২ জন বিচারপতি এ মামলায় শুনানি করেছেন, যাদের মধ্যে ৮ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। কেবল চারজন—এর মধ্যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ—ব্যবস্থাটি বাতিলের পক্ষে ছিলেন।
ড. ভূঁইয়া বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আপিল বিভাগ চাইলে একটি গাইডলাইন দিতে পারেন, যাতে ভবিষ্যতের নির্বাচনে রাজনৈতিক আস্থার ঘাটতি না থাকে।”
🔶 পটভূমি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একই বছরের ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের আবেদন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক—তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান।
পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (১৬ অক্টোবর) এবং জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার (২৩ অক্টোবর) পৃথকভাবে রিভিউ আবেদন করেন।
🔶 তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনি ইতিহাস
১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজন করা হয়। তবে ১৯৯৮ সালে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দাখিল করেন।
২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট রিট খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে। পরে ২০০৫ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। আপিল বিভাগে এ মামলায় আটজন অ্যামিকাস কিউরি মত দেন—তাদের মধ্যে পাঁচজন (ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, এম আমীর-উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ) ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন।
২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। এর পরই ৩০ জুন সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়।
এর পর থেকে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি জাতীয় নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।
উপসংহার:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রশ্নে চলমান এই শুনানিকে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আদালতের রায় শুধু নির্বাচন পদ্ধতি নয়, বরং দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ রূপরেখাকেও প্রভাবিত করবে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
