নিউজ ডেস্ক, প্রবাস বুলেটিন
বিশ্ব বাণিজ্যে এক নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি জারি করা এক নির্বাহী আদেশে তিনি বিশ্বের ১৮০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের পণ্যের ওপর নির্বিচারে ১০ শতাংশ ‘সর্বজনীন শুল্ক’ (ইউনিভার্সেল ট্যারিফ) আরোপ করেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশসহ ৬০টি দেশের ওপর ‘পাল্টা শুল্ক’ (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) হিসেবে ১০ শতাংশের চেয়েও বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যেগুলোর সবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে।
ট্রাম্পের ভাষায়, এই শুল্কারোপের মূল উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। কিন্তু এ জন্য যে সূত্র বা পদ্ধতি তিনি বেছে নিয়েছেন, তা অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকদের কাছে রীতিমতো “অদ্ভুত ও অযৌক্তিক” বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
শুল্ক নির্ধারণের অস্বাভাবিক সূত্র
২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছে মাত্র ২২১ কোটি ডলারের। ফলে বাণিজ্যঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬১৫ কোটি ডলার। ট্রাম্প প্রশাসন এই ঘাটতিকে রপ্তানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে যে ৭৪ শতাংশ হার পেয়েছে, সেটাকেই শুল্কহারে রূপান্তর করেছে। এর অর্ধেক ৩৭ শতাংশকে বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কহারে পরিণত করা হয়েছে—এমন একটি সিদ্ধান্ত যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তির রীতিনীতিকে কার্যত অগ্রাহ্য করেছে।
ডব্লিউটিওকে পাশ কাটানোর কৌশল
এই একতরফা সিদ্ধান্ত শুধু ক্ষুদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই বিপাকে ফেলছে না, বরং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) ও এর দীর্ঘদিনের রীতিবিধিকে কার্যত নিঃশেষ করার পথে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে ডব্লিউটিওর আপিল বিভাগ ট্রাম্প প্রশাসনের বিরোধিতার কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে, ফলে বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াও অনিশ্চিত।
দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ফাঁদ
অনেক দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার পথে হাঁটার চেষ্টা করছে। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া আমদানিতে শুল্ক শূন্য কিংবা কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও WTO বিধান অনুযায়ী, কোনো দেশ এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) ছাড়া এককভাবে শুল্ক ছাড় দিতে পারে না। একই অবস্থা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বর্তমানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে গড়ে মাত্র ৬ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে, যা ট্রাম্পের বিবেচনায় আসেনি। আবার বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক ১৫ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশের করণীয় কী?
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় এফটিএ করার চিন্তা প্রাসঙ্গিক হতে পারে, তবে তা কেবল পণ্য বাণিজ্যের সীমায় রাখতে হবে। সেবা, মেধাস্বত্ব বা বিনিয়োগ—এ ধরনের বিষয় যুক্ত না করাই উত্তম, কারণ এসব বিষয়ে বাংলাদেশের দরকষাকষির সক্ষমতা এখনও দুর্বল।
এফটিএ করলেও আমদানির পরিমাণ হঠাৎ করে বাড়বে না, তবে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। এতে আবার ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যঘাটতির উদ্বেগ আরও বাড়বে—যা চুক্তিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।
শেষ কথা
ট্রাম্পের এই নতুন শুল্কনীতি কেবল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নীতিমালাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে না, বরং এলডিসি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকেও মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে। এর ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য এক অনিশ্চিত ও দ্বিধাগ্রস্ত পথে পা বাড়াতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এখন প্রয়োজন কৌশলী, বাস্তবভিত্তিক ও দ্রুত সিদ্ধান্ত, যা দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।