ইসলামাবাদ, ২৬ এপ্রিল ২০২৫:
ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে সরে আসার ইঙ্গিতের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানেও সিমলা চুক্তি বাতিলের দাবিতে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে সরব হয়েছেন।
সাংবাদিক হামিদ মীর এক্স হ্যান্ডেলে বলেন, ‘ভারত যদি বিশ্ব ব্যাংকের অধীনে হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিল করে, তবে পাকিস্তানকেও সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসা উচিত। কারণ এতে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা জড়িত নয়।’ একইসঙ্গে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের সাবেক ‘প্রধানমন্ত্রী’ রাজা ফারুক হায়দার বলেন, ‘ভারত একতরফাভাবে সিন্ধু চুক্তি বাতিল করেছে। পাকিস্তানকেও উচিত সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা, বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যুতে।’
অনেক পাকিস্তানি নাগরিক এবং বিশ্লেষক মনে করছেন, সিমলা চুক্তি পাকিস্তানকে কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে নিরুৎসাহিত করেছে। ফলে চুক্তিটি বাতিল হলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে কাশ্মীর প্রশ্নে আরও সরব হতে পারবে বলে অনেকে আশাবাদী।
সিমলা চুক্তির পটভূমি ও তাৎপর্য
সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে, ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে। চুক্তিটি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে ভারতের সিমলা শহরে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ শান্তিপূর্ণভাবে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির অঙ্গীকার করে। এছাড়া নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) নির্ধারিত হয় এবং একতরফাভাবে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হয়।
‘মৃত চুক্তি’র বিতর্ক
পাকিস্তান বিষয়ক পর্যবেক্ষক সুশান্ত সারিন বলেন, ‘সিমলা চুক্তি থেকে পাকিস্তানের সরে যাওয়া ভারতের জন্য কোনো ধাক্কা নয়। বরং এটি কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সহজ করে দেবে। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান বহু আগেই এই চুক্তির নিয়ম ভঙ্গ করেছে।’
তার মতে, সিমলা চুক্তি বাস্তবায়নে পাকিস্তানের উদাসীনতা প্রমাণ করে যে এটি একরকম মৃত চুক্তি। তিনি বলেন, ‘কার্গিল যুদ্ধ কিংবা সন্ত্রাসীদের মদদ সিমলা চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। এখন যদি পাকিস্তান এই মৃত চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
অন্যদিকে, কাশ্মীরি আইনবিদ মির্জা সায়ব বেগ বলছেন, ‘চুক্তি এখনো কার্যকর এবং দুই দেশ এর বাস্তবায়নে বাধ্য। পাকিস্তান চাইলে আন্তর্জাতিক আদালতে এই বিষয়ে মামলা করতে পারত, কিন্তু সেটা তারা করেনি।’
ভারতের ওপর প্রভাব পড়বে?
সিমলা চুক্তির বাতিল কি ভারতের ওপর প্রভাব ফেলবে—এমন প্রশ্নে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলেন, ‘সিমলা চুক্তির কোনো বাস্তব তাৎপর্য এখন আর নেই। পাকিস্তান প্রতিনিয়ত এই চুক্তি লঙ্ঘন করে আসছে। ফলে তাদের আনুষ্ঠানিক সরে আসা ভারতের জন্য প্রভাববিহীন।’
তিনি বলেন, ‘৩৭০ ধারা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল, তাই তা সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন নয়। পাকিস্তান সরে গেলেও ভারতে এর কোনো কূটনৈতিক বা নিরাপত্তাগত প্রভাব পড়বে না।’
চুক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ
পররাষ্ট্র বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ‘সিমলা চুক্তি ও সিন্ধু পানি চুক্তি—দুটিই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের একটি নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করেছিল।’ তার মতে, দুটি চুক্তির একটি যদি বাতিল হয়, অন্যটিও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
তবে অধ্যাপক মহেন্দ্র লামার ভাষায়, ‘সিমলা চুক্তি মৃত, অথচ সিন্ধু পানি চুক্তি এখনো কার্যকর ও জীবন্ত। তাই একটির প্রতিক্রিয়ায় অন্যটি বাতিল কোনো যৌক্তিক জবাব নয়।’