আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ১৭ মে ২০২৫
দখলদার ইসরায়েল গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে শুক্রবার ভোর থেকে স্থল ও আকাশপথে ভয়াবহ হামলা শুরু করেছে। বিশেষ করে বেঈত লাহিয়া শহরে সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক প্রবেশ করে ব্যাপক গোলাবর্ষণ চালানো হয়। একই দিনে ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় প্রাণ হারান অন্তত ১৪৩ ফিলিস্তিনি। এতে গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা ৫৩ হাজার ছাড়িয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মার্চের পর গাজার উত্তরে এটিই সবচেয়ে বড় ইসরায়েলি হামলা। সকাল থেকেই ধোঁয়ার বোমা ছুড়ে গোলাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। পরে তারা ট্যাংকসহ বেঈত লাহিয়ার আল-সালাতিন এলাকায় অগ্রসর হয় এবং একটি স্কুল ঘিরে ফেলে, যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল শত শত বেসামরিক মানুষ।
দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল গাজায় কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। এ সময়ের মধ্যে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ একেবারে বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে লাখো ফিলিস্তিনি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গাজাবাসীর দুর্ভোগে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দখলদার ইসরায়েলের সমালোচনা না করে হামাসকে অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন যে, গাজার মানুষ অনাহারে দিন পার করছেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিচ্ছে—তা স্পষ্ট করেননি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৩ হাজার ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জন আহত হয়েছেন। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও কয়েক হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে, যাদের অনেকেই মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
শুধু শুক্রবার নয়, এর আগের দিন ১৬ মে নাকবা দিবস উপলক্ষে গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা যখন তাদের গৃহচ্যুতি ও জাতিগত নিধনের স্মরণে দিনটি পালন করছিলেন, তখনও ইসরায়েল ব্যাপক হামলা চালায়। বৃহস্পতিবার নিহত হন অন্তত ১১৫ জন।
নাকবা দিবসের প্রেক্ষাপট:
১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন। আরবি “নাকবা” শব্দের অর্থ ‘বিপর্যয়’, যা ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসে গভীর ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়েছে। সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই এবারও ৭৭তম নাকবা দিবস পার করলেন গাজা ও পশ্চিম তীরের লাখো ফিলিস্তিনি—যাদের অনেকে বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের বাসিন্দা বাদরিয়া মোহারেব বলেন, “১৯৪৮ সালে পরিবারসহ জাফা থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। তখনও শিশু ছিলাম। আজ আবার দেখছি, আমার দুই নাতি নিহত হয়েছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন ভয়াবহতা আগে দেখিনি।”
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা এখন ‘নো গো এরিয়া’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধনের আশঙ্কা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
সংঘাতের সূচনা ও প্রেক্ষাপট:
বর্তমান সংঘাতের সূচনা হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যখন হামাস ইসরায়েলের ভেতরে প্রবেশ করে হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ১৩৯ জন ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২০০ জনের বেশি জিম্মি হন। এর প্রতিক্রিয়ায় হামাস নির্মূলের লক্ষ্যে গাজা উপত্যকায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েল।
উপসংহার:
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্ব নেতারা ইসরায়েলের হামলা বন্ধ এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানালেও যুদ্ধবিরতির কোনো বাস্তব অগ্রগতি এখনো দেখা যাচ্ছে না। নাকবার ৭৭তম বার্ষিকীতে নতুন করে যে বিপর্যয় নামল ফিলিস্তিনিদের ওপর, তা মানবিক ইতিহাসে আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলো।