📍 ঢাকা, ২৬ মে ২০২৫
আন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের পদত্যাগের ইঙ্গিত রাজনীতিতে এক নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যদিও তিনি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি, তবুও গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তাঁর হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশের পর থেকে বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা, প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার গভীর মতবিরোধ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ওই বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, “সংস্কারের বিষয়েও এখনো তেমন কিছু হলো না। তাহলে আমি কেন থাকব?”—এই মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, তিনি গভীর হতাশায় রয়েছেন এবং পদত্যাগের বিষয়টি এখনো উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
সংস্কার বন্ধ্যাত্ব ও রাজনৈতিক অনৈক্য
নয় মাস পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। প্রথম ছয়টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর চার মাস কেটে গেলেও তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য যেমন দায়ী, তেমনি সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বিধা ও দায়সারা মনোভাবও ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসনিক নিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার বিভাগ—এসব মৌলিক ক্ষেত্রে সংস্কার ব্যতিরেকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। অথচ নির্বাচন কমিশন গঠনসহ প্রশাসনে নিয়োগ ও বদলিতে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার ঘাটতি দেখা গেছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সরকার বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতামতের ভিত্তিতে পদোন্নতি ও বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেটি বর্তমানে নিজেদের বিপক্ষে গিয়েও দাঁড়াচ্ছে।
সরকারের আচরণে পক্ষপাতের অভিযোগ
সম্প্রতি শাহবাগ, যমুনা সেতু ও জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের আচরণ নিয়েও ওঠেছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। একদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিতে পুলিশ ছিল সহনশীল, অন্যদিকে ছাত্র-শ্রমিকদের আন্দোলনে লাঠিচার্জ ও গণগ্রেপ্তার চালানো হয়েছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা জামিন পেলেও সাধারণ নাগরিক, এমনকি নারী ও শিশুরাও জামিন পাচ্ছেন না।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করছেন, সরকার নিজের গঠনের সময় যে দলগুলোকে খুশি করতে গিয়ে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনে পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগ দিয়েছে, এখন তারই ফল ভোগ করছে। এর ফলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কার্যত কোনো নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব
বিশ্লেষকদের মতে, সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও ঐকমত্য তৈরিতে সরকারের ব্যর্থতা এখন স্পষ্ট। সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ জনগণের সামনে তুলে ধরার, জনমত গঠনের কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় আনয়নের কোনো কার্যকর প্রয়াস দেখা যায়নি।
সরকারের ভেতরে থাকা কয়েকজন উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। বিএনপি যেমন ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি করছে, তেমনি এনসিপি পাল্টা অভিযোগে অন্য উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি করছে। এতে করে সরকারের অভ্যন্তরে বিভাজন ও আস্থাহীনতা আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
বিচার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক
সরকারের ব্যর্থতার আরেকটি বড় দিক হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ধারাবাহিকতা। মহাসড়কে নিয়মিত ডাকাতি, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা, পাঠাগারে হামলার মতো ঘটনায় সরকার কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে অনেকেই সরকারকে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলেও অভিহিত করছেন।
উপসংহার
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্দিষ্ট দলের নয়, বরং দেশের সব গণতন্ত্রকামী মানুষের সরকার—এই বার্তাটি শুধু মুখে নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে। সংস্কার প্রক্রিয়াকে গতি দিতে হবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতা ফেরাতে হবে। এর পাশাপাশি নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি গ্রহণযোগ্য সময়সূচি ঘোষণার মাধ্যমেই সরকার জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।