ওয়াশিংটন, ২৯ জুন ২০২৫:
পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনার জন্য পর্দার আড়ালে তৎপরতা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তেহরানের জন্য একটি বেসামরিক পরমাণু প্রকল্প গড়ে তোলার প্রস্তাবসহ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা করছে ওয়াশিংটন। একই সঙ্গে দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও জব্দ থাকা অর্থ ছাড়ের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।
অঘোষিত প্রস্তাবনায় কী আছে?
সিএনএনের কাছে প্রকাশিত চারটি সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের সংঘাত চলাকালে ও যুদ্ধবিরতির পর যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি মিত্র দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে গোপন আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় ইরানের একটি নতুন বেসামরিক পরমাণু প্রকল্প গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অনুমতি থাকবে না।
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, মধ্যপ্রাচ্যের অংশীদার দেশগুলোই এই প্রকল্পের অর্থায়ন করুক। খসড়া প্রস্তাবে বিদেশি ব্যাংকে জব্দ থাকা ইরানের ৬০০ কোটি ডলার ব্যবহারের অনুমতি, ফর্দো পরমাণু স্থাপনাটি পুনর্গঠনের জন্য সহায়তা এবং পরমাণু জ্বালানি আমদানির সুযোগ দেওয়ার বিষয় উল্লেখ আছে।
ইরানের ‘না’ ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল
সূত্র বলছে, ইরান এখনো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে রাজি হয়নি। ওয়াশিংটনের অবস্থান পরিষ্কার—এই কর্মসূচিকে প্রতিরোধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিভ উইটকফ বলেন, “আমরা এমন একটি পরমাণু প্রকল্প গড়ে দিতে চাই, যা বেসামরিক হবে এবং যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হবে না।”
পটভূমিতে সামরিক হামলা ও কূটনৈতিক উত্তেজনা
গত ১৩ জুন শুরু হওয়া ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের অংশ হিসেবে ২১ জুন রাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান কেন্দ্রের অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে বলে দাবি করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই হামলার মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি একটি ‘কঠোর বার্তা’ পাঠানো হয়েছে বলেই মনে করছে মার্কিন প্রশাসন। ট্রাম্প বলেন, “আলোচনার পথ এখন উন্মুক্ত। তবে শর্ত অপরিবর্তিত থাকবে।”
চুক্তি পুনরায় শুরুর আশা
২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে সরে দাঁড়ায়। এরপর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। চলতি বছর আবারো নতুন চুক্তির লক্ষ্যে পাঁচ দফা আলোচনা হলেও ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর কারণে ষষ্ঠ দফা স্থগিত হয়ে যায়।
তবে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আলোচনার জন্য একটি নতুন সুযোগ আসছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাটো সম্মেলনে বলেন, “আমরা ইঙ্গিত পাচ্ছি—ইরান আলোচনায় রাজি।” স্টিভ উইটকফের ভাষ্য, “ইরানিদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। একাধিক মধ্যস্থতাকারী আলোচনায় আগ্রহী।”
তেহরানের অবস্থান কঠোর
তবে ইরানের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সাড়া আসেনি। বরং দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিক্রিয়ায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—যেকোনো ভবিষ্যৎ হামলার জবাব আরও শক্তিশালী হবে। এ ছাড়া তেহরান জাতিসংঘের পরমাণু নজরদারি সংস্থা আইএইএ থেকে সরে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
বিশ্লেষণ:
যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাব তেহরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরানোর একটি কৌশল হলেও বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে দুই পক্ষকেই। ইরানের ‘স্বাধীন পরমাণু কর্মসূচি’ রক্ষা করার সংকল্প এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিরস্ত্রীকরণ’ প্রচেষ্টা—দুইয়ের সংঘাতই ভবিষ্যৎ চুক্তির মূল চ্যালেঞ্জ।