যুক্তরাষ্ট্র–ইসরাইল সাত দিনের মধ্যে নতুন হামলায় প্রস্তুত: তেহরানের উদ্বেগ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
প্রবাস বুলেটিন ডেস্ক | ১ জুলাই ২০২৫
১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির মাত্র এক সপ্তাহ পেরোতেই ফের বড় ধরনের হামলার শঙ্কা উত্থাপন করেছেন ইরানের শীর্ষ বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. ইব্রাহিম মোত্তাকি। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের প্রধান এই বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, সাত দিনের মধ্যে ইরানে আবারও ধ্বংসাত্মক হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।
রোববার ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এই যুদ্ধবিরতি কৌশলগতভাবে শান্তির আড়ালে নতুন হামলার প্রস্তুতির সময় হতে পারে। তেহরান যেন এই মুহূর্তে আত্মতুষ্টিতে না ভোগে।”
ইরানি কর্তৃপক্ষকে মোত্তাকির সতর্কবার্তা
মোত্তাকি সতর্ক করেন, “এইবার হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন খোদ ইরানি শীর্ষ কর্মকর্তারা।” তিনি দাবি করেন, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত বিরতি নিয়ে আক্রমণের জন্য উপযুক্ত সময় ও সুযোগ খুঁজছে।
এর মধ্যেই ইরানি সামরিক প্রধান আবদুর রহিম মুসাভি এবং সাবেক ন্যাটো কর্মকর্তা ইউসুফ আলাবার্দা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করতে পারেন। ইরানের সামরিক বাহিনী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ড ব্যবহার করে আক্রমণের সম্ভাব্য চেষ্টার ওপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছে।
ইরানের কূটনৈতিক প্রস্তুতি ও কঠোর বার্তা
সোমবার এক সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই জানিয়েছেন, সব প্রতিবেশী দেশ আশ্বস্ত করেছে— তারা ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল বা অন্য কোনো শক্তিকে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না।
এছাড়া ইরান এবার আগেভাগেই সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। পার্লামেন্টে “বিদেশি শত্রুকে সহায়তা করলে মৃত্যুদণ্ড”— এমন বিধান রেখে নতুন আইন পাস করা হয়েছে। একইসঙ্গে অননুমোদিত ইন্টারনেট সংযোগ (যেমন স্টারলিংক) ব্যবহার করাও এখন দণ্ডনীয় অপরাধ।
নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘ফতোয়া’
এদিকে ইরানের শীর্ষ শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি এক ঐতিহাসিক ফতোয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে “আল্লাহর শত্রু” আখ্যা দিয়েছেন। মুসলিম বিশ্বকে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
পরমাণু ইস্যুতে উত্তেজনা তুঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখনো এর সম্পূর্ণ পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি। আইএইএ পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, জানিয়েছে তেহরান।
জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির-সাঈদ ইরাভানি বলেন, “ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কোনো অবস্থাতেই বন্ধ হবে না। শান্তিপূর্ণ জ্বালানি উৎপাদনের অধিকার আমাদের আছে এবং সেটি আমরা বাস্তবায়ন করব।”
ম্যাক্সার টেকনোলজিস প্রকাশিত নতুন স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ফোর্দো কেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নতুন নির্মাণকাজ চলছে। বুলডোজার, এক্সকেভেটর এবং লরি ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত বাংকার এলাকায় মেরামত চালানো হচ্ছে।
আলোচনার সম্ভাবনা? ট্রাম্পের জবাব ‘না’
যুদ্ধবিরতির পর যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার কথা বললেও ইরান শর্ত দিয়েছে— “আগে হামলার পরিকল্পনা বন্ধ করুন, পরে কথা হবে।” তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, “আমি ইরানের সঙ্গে কোনো আলোচনা করছি না, কোনো প্রস্তাবও দিচ্ছি না।” অথচ একই সঙ্গে তিনি তেহরানের তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা শিথিলের আভাস দিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এ দ্বৈত বার্তা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বিভ্রান্তি কিংবা আলোচনার জন্য চাপ তৈরির কৌশল— যেটি তেহরান সহজে বিশ্বাস করছে না।
হতাহতের চিত্র
১৩ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ইরান-ইসরাইল সংঘাতে ইরানে ৯৩৫ জন নিহত হন এবং হাজারের বেশি আহত হন। ইসরাইলে নিহত হয় ২৯ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মধ্যপ্রাচ্যের সর্বশেষ সময়ের অন্যতম রক্তাক্ত সংঘাত।
উপসংহার
মধ্যপ্রাচ্যে সাময়িক শান্তির পরেও নতুন অশান্তির পূর্বাভাস যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইরান আক্রমণের সম্ভাব্য পরিকল্পনা, ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি এবং ফতোয়ার মতো কট্টর বার্তা মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে আবারও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সংঘাত শুধু ইরান বা ইসরাইল নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে আবারও ভয়াবহ সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের এখনই প্রয়োজন বাস্তবসম্মত কূটনীতি, নয়তো আগুন জ্বলবেই।