নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রবাস বুলেটিন
অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি এখনো সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য সংকটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অর্থনীতির সামনে এখনো বহুমুখী চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে। পরিকল্পনা কমিশনের একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে। এটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামেও উপস্থাপন করা হয়েছে।
দুর্নীতির প্রভাব, দুর্বল রাজস্ব এবং বিনিয়োগ সংকট
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত সরকারের সময় ব্যাপক দুর্নীতির কারণে অর্থনীতিতে ধস নামে। এ থেকে উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারমুখী নানা পদক্ষেপ নিলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক বিদেশি বিনিয়োগে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এতে করে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং শিল্পখাতে নতুন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভক্তি ও অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায়ে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। সরকারের পর্যাপ্ত আয় না থাকায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নও ব্যাহত হচ্ছে।
সংস্কারে টাস্কফোর্স ও কমিশন গঠন
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার, দুর্নীতি দমন এবং লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণসহ নানা খাত। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক সূচকে কিছু ইতিবাচকতা, তবে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
প্রতিবেদনে জানানো হয়, জুলাই মাসে কিছু সূচকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত মিলেছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত। বহুজাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৯ থেকে ৪.১ শতাংশ হতে পারে। ২০২৬ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ৫.১ থেকে ৫.৩ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি মুদ্রা বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। প্রতি ডলার ১২২.৪৫ থেকে ১২২.৭০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। অর্থ পাচার কমে আসায় দেশে অর্থের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে, তবে ব্যাংকিং খাতে আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
চালের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে উৎপাদন খরচ ও মজুদের ভূমিকা
প্রতিবেদনে কৃষিখাতে চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়েছে সার, সেচ, শ্রমিক, পরিবহন ও মজুদের খরচ বৃদ্ধি। বোরোর বাম্পার ফলনের পরও বাজারে চালের মূল্য কমেনি। ফলে সরকার বাজার তদারকিতে আরও সক্রিয় হচ্ছে।
এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি ও বাধা
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিশুদ্ধ পানি, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে লিঙ্গ সমতা, সম্পদ বৈষম্য হ্রাস, টেকসই জীবনযাত্রা ও অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। এসব খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়েছে।
উপসংহার
২০২৪ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন সরকার জবাবদিহি ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে এবং নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতিকে টেকসইভাবে দাঁড় করাতে প্রয়োজন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোর দ্রুত সংস্কার।