২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন এক রাজনৈতিক কৌশলে মাঠে নেমেছেন। ক্ষমতার প্রশ্নে জনগণের রায় তাঁকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেললেও মোদি নিজের ভাবমূর্তি পুনর্গঠনে এখন আগের চেয়েও বেশি সক্রিয়।
ভাবমূর্তির পুনর্গঠন ও পুরনো কৌশলের প্রত্যাবর্তন
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মোদি এখন সরকার পরিচালনার চেয়ে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার কৌশলেই বেশি মনোযোগী। এই কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে পাস করিয়েছেন ওয়াকফ সংশোধনী বিল। যদিও বিলটি মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থী বলে অনেকে মনে করেন, বিজেপি এটিকে ‘কল্যাণমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
ওই বিলের মাধ্যমে মোদি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও সংসদে তিনি আইন পাস করাতে পারেন। এতে সমর্থন দিয়েছে জেডিইউ, টিডিপি ও লোক জনশক্তি পার্টির মতো তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মিত্ররা।
রাজনৈতিক পরাজয়ের অভিঘাত ধুয়ে ফেলার প্রচেষ্টা
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির একক ক্ষমতা হারানো মোদির জন্য ছিল এক বড় ধাক্কা। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টির উত্থান, মহারাষ্ট্রে হারের ধাক্কা এবং এমনকি অযোধ্যার ফৈজাবাদ আসনে পরাজয় মোদির রাজনৈতিক কৌশলে নতুন করে চিন্তা আনতে বাধ্য করে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে মোদি বেছে নেন তাঁর পুরনো কৌশল—হিন্দু-মুসলিম বিভাজন, জাতীয়তাবাদী আবেগের পসরা এবং বিরোধীদের দেশদ্রোহী আখ্যা। সংসদের প্রথম ভাষণেই তিনি সমালোচকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন। এরপর প্রতিটি বক্তব্যেই নিজেকে জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেন—“মোদি মানেই দেশ” এই বার্তাটি ছড়িয়ে দেন সর্বত্র।
আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের প্রতীকী পদক্ষেপ
নির্বাচনের আগে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার ‘আরএসএসের ওপর নির্ভরতা নেই’—এই বক্তব্যের জেরে সংঘ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়। এই টানাপোড়েন মেটাতে মোদি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাগপুরে আরএসএস সদর দপ্তরে গিয়ে আনুগত্য জানান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এটিকে প্রতীকী হলেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে দেখছেন।
বিজেপির পরাজয়, তবু জোরালো প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা
নির্বাচনের ফলাফল মোদির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করলেও বিজেপি তা কাটিয়ে উঠতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। হরিয়ানায় ক্ষমতায় ফেরা, মহারাষ্ট্রে ভালো ফল এবং জম্মু অঞ্চলে সাফল্য তাদের পুনরুদ্ধার কৌশলের অংশ। পাশাপাশি, হিন্দু উৎসবগুলোকে ব্যবহার করে মুসলিমবিরোধী আবেগ উসকে দেওয়া, ভোটকেন্দ্রে মুসলিম ভোটারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের হিন্দুত্বের কঠোর অবস্থান ইত্যাদির মাধ্যমে বিজেপি এক পরিচিত কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।
বিরোধী জোটের বিভাজন: মোদির জন্য বাড়তি সুযোগ
নির্বাচনের পর বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট একবার যৌথ বৈঠকে বসলেও তার পর আর একতাবদ্ধভাবে কোনো কার্যকর বার্তা দিতে পারেনি। ডিএমকে ও কিছু দ্রাবিড় দল ব্যতিক্রম হিসেবে দাঁড়ালেও সামগ্রিক বিরোধিতা ছিল ছন্নছাড়া। এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে মোদি আবারও দৃশ্যপটে প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন।
আসছে প্রশ্নের মুখোমুখি মোদি
তবে রাজনৈতিক সফলতার বাইরেও ভারতের অর্থনীতি, মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সংকট, আদমশুমারির অগ্রগতি ও নারীদের সংরক্ষণ বিলের বাস্তবায়ন নিয়ে মোদি সরকার কঠিন প্রশ্নের মুখে। আদালতের হস্তক্ষেপ, দ্রাবিড় রাজনীতির ঘুরে দাঁড়ানো এবং দক্ষিণে হিন্দুত্বের বিরোধিতা ভবিষ্যতে মোদির জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
উপসংহার: পুরনো কৌশলের নতুন মোড়
মোদি সরকারের বর্তমান কৌশল যেন সেই পুরোনো বার্তাই পুনরায় জোর দিয়ে বলছে—“দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ” (TINA)।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই কৌশল কত দিন কার্যকর থাকবে? মোদি কি সত্যিই বাস্তব সমস্যাগুলো ঢেকে রাখতে পারবেন? সময়ের সঙ্গে সেই উত্তরই নির্ধারণ করবে ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।