ক্ষমতায় ফিরে ইউক্রেন যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থামানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। একাধিকবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি ও ফোনে কথা বলেন তিনি। তবে হঠাৎ করেই ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে দ্রুত অগ্রগতি না হলে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন সংকট থেকে সরে আসবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থান পাল্টে যাওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের রাজনীতি: খনিজ ও গ্যাস পাইপলাইনের দখল দাবি
ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র এরইমধ্যে দেশটির অর্ধেক খনিজ সম্পদের উপর অধিকার আদায়ের চুক্তি করেছে। সর্বশেষ তারা দাবি জানিয়েছে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহকারী ঐতিহাসিক পাইপলাইনটির নিয়ন্ত্রণ—যেটি সোভিয়েত আমলে নির্মিত এবং ইউক্রেনের উজহোরোদ হয়ে স্লোভাকিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স করপোরেশনের হাতে এই পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ দেওয়ার চাপ আসছে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের ঔপনিবেশিক চাপে ইউক্রেনের পক্ষে সম্মত হওয়া সম্ভব নয়।
৫০০ বিলিয়ন ডলারের খনিজ চুক্তি, বিনিময়ে সামরিক ঋণ ফেরত দাবি
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়। এতে খনিজ, তেল, গ্যাস এবং অবকাঠামোগত খাতে মার্কিন বিনিয়োগের কথা বলা হয়। যদিও ইউক্রেন সরকার এটিকে যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের সহযোগিতা হিসেবে দেখাচ্ছে, বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র এই বিনিয়োগের বিনিময়ে সামরিক সহায়তার অর্থ ফেরত চাচ্ছে।
ইউক্রেনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২৬ এপ্রিলের মধ্যে এই চুক্তি চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি চাইছেন বিনিময়ে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাদের ব্যবসায়িক উপস্থিতিই হবে রাশিয়ার জন্য প্রতিরোধমূলক বার্তা।
ভূখণ্ড দখলে ব্যস্ত রাশিয়া, যুদ্ধবিরতির শর্তে চাপে ইউক্রেন
যখন যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন রাশিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে ক্রমান্বয়ে হামলা চালিয়ে ভূমি দখল করে নিচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের (ISW) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ৪,১৬৮ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ড দখল করেছে। এটি নিউইয়র্ক সিটির পাঁচগুণ আয়তনের সমান।
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া যুদ্ধবিরতির আগে বেশি জমি দখল করে আলোচনার টেবিলে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে চাইছে। ফলে যুদ্ধবিরতির আলোচনা বিলম্বিত হচ্ছে, যা ইউক্রেনের কৌশলগত ক্ষতির কারণ হতে পারে।
চুক্তির শর্তে ধোঁয়াশা: ক্রিমিয়া কি ছাড় দিতে যাচ্ছে আমেরিকা?
২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রেও একটি নতুন মোড় এসেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইঙ্গিত দিয়েছেন, শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে পারে। যদিও ইউক্রেন এমন কোনো ছাড় দিতে নারাজ।
জেলেনস্কি এর আগে জানিয়েছিলেন, কৌশলগতভাবে কিছু সীমান্ত এলাকা বিনিময়ের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে রাশিয়া তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
উপসংহার: চুক্তি না হলে ‘পিছু হটবে’ আমেরিকা
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুত একটি চুক্তি চাইছেন। কিন্তু খনিজ, ভূখণ্ড ও নিরাপত্তা ইস্যুতে সমাধানে না পৌঁছানোয় হোয়াইট হাউজ থেকে চাপ বাড়ছে। তাই ট্রাম্পের সাম্প্রতিক হুঁশিয়ারি—যুদ্ধবিরতির অগ্রগতি না হলে ইউক্রেন থেকে মার্কিন সরে যাওয়া—নতুন করে আলোচনার গতিপথ পাল্টে দিতে পারে।