প্রকাশিত: রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক আদর্শকে সামনে রেখে সংঘটিত মব সহিংসতা নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের অপরাধ বেড়েছে এবং রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্র যখন অপরাধীদের কঠোরভাবে দমন করে না, তখন দায়মুক্তির সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়।
লালমনিরহাটের ২০২০ সালের ঘটনা
২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রামে শহীদুন্নবী জুয়েলকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়, পরে তার মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনায় রাষ্ট্র দ্রুত পদক্ষেপ নেয়; প্রধান আসামিসহ কয়েকজনকে দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ভিডিও ফুটেজ ধরে আসামিদের শনাক্ত করা হয়।
গোয়ালন্দের ২০২৫ সালের ঘটনা
গত ৫ আগস্ট রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে আগুনে পোড়ানো হয়। নেতৃত্বে ছিল স্থানীয় ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। এ সময় সংঘর্ষে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। দরবারের খাদেম রাসেল মোল্লা গুরুতর আহত হয়ে পরে মারা যান। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে একটি মব হত্যাকাণ্ড।
আদর্শগত অপরাধ ও দায়মুক্তি
বিশ্লেষকদের মতে, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের নামে সংঘটিত অপরাধকে ‘আদর্শগত অপরাধ’ বলা যায়। অপরাধীরা এসব কাজকে অপরাধ মনে করে না, বরং নিজেদের উচ্চতর আদর্শ রক্ষাকারী মনে করে। রাষ্ট্র যখন বিচার করে না, তখন এ ধরনের অপরাধ আরও উৎসাহিত হয়।
রাষ্ট্রের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া
প্রথম আলোর (১৮ জানুয়ারি ২০২৫) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে পাঁচ মাসে ৪০টি মাজার ও দরগাহে ৪৪টি হামলা হয়েছে। অথচ এসব ঘটনায় মাত্র ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ থাকলেও বাকিদের বিষয়ে রাষ্ট্র নীরব।
অন্যদিকে রাজনৈতিক আদর্শগত সহিংসতার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। ধানমন্ডি ৩২–এ দুই দিন ধরে মব সন্ত্রাস চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছিল, মামলাও হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
-
ফরাসি মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ লে বনের ক্রাউড সাইকোলজি তত্ত্ব অনুযায়ী, ভিড়ে একজন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত নৈতিকতা হারিয়ে সমষ্টিগত সত্তায় মিশে যায় এবং এমন কাজ করে যা একা করলে করত না।
-
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বৈধ সহিংসতার একচেটিয়া অধিকার। যখন রাষ্ট্র মবকে দমন করে না, তখন সে তার মূল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়।
উপসংহার
বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রের বর্তমান নীরবতা ও নমনীয়তা নাগরিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে। প্রশ্ন রয়ে যায়—বাংলাদেশ কি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মবের নিয়ন্ত্রণে যাবে, নাকি নাগরিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে?