প্রকাশের তারিখ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ঢাকা
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক সংবেদনশীল ও রূপান্তরমুখী পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রবাসী আয়ে সাময়িক স্বস্তি ফিরলেও, ব্যাংকিং খাতের অস্বাস্থ্যকর ঋণ প্রবণতা, সীমিত রফতানি প্রবৃদ্ধি এবং রাজস্ব ঘাটতি ভবিষ্যতের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (১২ অক্টোবর ২০২৫) নির্বাচিত অর্থনৈতিক সূচক অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরের মধ্যভাগে প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব ও রিজার্ভ—এই তিন সূচকই নতুন ভারসাম্যের সন্ধানে রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “এখন সময় সঙ্কটের আগেই সাড়া দেওয়ার”—না হলে আর্থিক খাতের দুর্বলতা সামষ্টিক অর্থনীতিকেও নড়বড়ে করে দিতে পারে।
🔹 রিজার্ভে সাময়িক স্থিতি, রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবাহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বিপিএম-৬ অনুযায়ী ২৭.১ বিলিয়ন ডলার)। যদিও এটি ২০২১ সালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক কম, তবু গত বছরের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে এসেছে উল্লেখযোগ্য উত্থান—২০২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬.৮৩ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয় প্রায় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্স এখন অর্থনীতির “লাইফলাইন”—যা আমদানি ঘাটতি মোকাবিলা ও চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখছে।
তবে তারা সতর্ক করছেন, ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আগামী মাসগুলোতে রিজার্ভে পুনরায় সংকট তৈরি করতে পারে।
🔹 রফতানিতে সীমিত অগ্রগতি, আমদানিতে চাপ অব্যাহত
২০২৫ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে ৪৩.৯৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে—যা আগের বছরের তুলনায় ৭.৭২ শতাংশ বেশি। তবে একই সময়ে আমদানি বেড়ে ৬৮.৩৫ বিলিয়ন ডলার হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি আরও বিস্তৃত হয়েছে।
রফতানির প্রধান অবদান এখনো তৈরি পোশাক খাতনির্ভর, যেখানে পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রয়চাহিদা হ্রাস বড় ঝুঁকি হয়ে উঠেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “রফতানি খাতে প্রযুক্তিনির্ভর ও মূল্যসংযোজিত পণ্যে রূপান্তর ছাড়া মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।”
🔹 ব্যাংক খাতে অস্বাস্থ্যকর ঋণ প্রবণতা উদ্বেগজনক
২০২৫ সালের মার্চে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২৪.১৩ শতাংশই অনাদায়ী বা খেলাপি, যা ২০২৩ সালের মার্চে ছিল মাত্র ৮.৮০ শতাংশ।
গত এক বছরে খেলাপি ঋণের হার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে—মার্চ ২০২৪-এ ১১.১১%, জুনে ১২.৫৬%, সেপ্টেম্বর ১৬.৯৩%, ডিসেম্বর ২০.২০% এবং মার্চ ২০২৫-এ ২৪.১৩%।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“এখনকার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, ব্যাংকগুলো নিজেরাই তারল্য সঙ্কটে পড়ছে। তাদের সম্পদের বড় অংশ অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়েছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাবিত ঋণ বিতরণ, দুর্বল তদারকি ও শিথিল পুনঃতফসিল নীতি ব্যাংক খাতের এই দুর্বলতার প্রধান কারণ।
🔹 রাজস্বে স্থবিরতা, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমছে
২০২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২.২৩% বেশি। অর্থাৎ, রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম।
অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বড় ধস দেখা দিয়েছে—নেট বিক্রি নেতিবাচক ৬,০৬৩ কোটি টাকা। এটি ইঙ্গিত করে জনগণ সঞ্চয়ের পরিবর্তে নগদ অর্থ বা ব্যাংকে অর্থ রাখাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
🔹 মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু জীবনযাত্রায় চাপ
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ বারো মাসের গড় মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ৯.৯৭%)। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে এটি ৮.৩৬ শতাংশ, যা আগের বছরের ১১.৬৬ শতাংশের চেয়ে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কঠোর মুদ্রানীতি ও রফতানি আয়ের উন্নতি এ প্রবণতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তবুও খাদ্য, জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় উচ্চতর পর্যায়ে রয়ে গেছে।
🔹 প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা
২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৯৭ শতাংশে, যা ২০২৩ সালের ৫.৭৮ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। শিল্প ও এসএমই ঋণ বিতরণে পতন এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা এ প্রবণতাকে আরও গভীর করেছে।
🔹 বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবিত করণীয়
অর্থনীতিবিদরা পাঁচটি জরুরি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন:
-
ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন ও কঠোর তদারকি: খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
-
রফতানি বৈচিত্র্যকরণ: পোশাক খাতের বাইরে আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষি ও হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিনিয়োগ।
-
রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কার: আধুনিক ভ্যাট, কর ও শুল্ক ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানো।
-
স্মার্ট আমদানি নিয়ন্ত্রণ: বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি সীমিত করে রিজার্ভ সুরক্ষা।
-
নীতিগত ভারসাম্য: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।
সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনৈতিক সূচক, এনবিআর, অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ
সারসংক্ষেপে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—একদিকে রেমিট্যান্স ও রিজার্ভে আশার আলো, অন্যদিকে ব্যাংকিং খাত ও প্রবৃদ্ধির কাঠামোগত দুর্বলতা। সময়মতো সংস্কার না এলে সাময়িক স্বস্তি স্থায়ী সমাধানে রূপ নাও নিতে পারে।
— প্রবাস বুলেটিন অর্থনীতি ডেস্ক
