প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২৫, মঙ্গলবার
নিজস্ব প্রতিবেদক:
দীর্ঘ দেড় দশকের লুটপাট, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় প্রায় ডুবন্ত অবস্থায় চলে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে। তবে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, ব্যাংক খাতের আস্থাহীনতা, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং রাজস্ব খাতের অস্থিরতা অর্থনীতিকে এখনো ঝুঁকির মুখে রেখেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশ বর্তমানে সম্ভাবনা ও সংকটের এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে।
রিজার্ভে স্বস্তি, বাড়ছে রেমিট্যান্স
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার (বিপিএম-৬ অনুযায়ী ২৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার)। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভও বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারে, যা এক বছরে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। একই সময়ে স্থগিত বিল পরিশোধেও ৪ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে।
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে ৪৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্স প্রবাহও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত এসেছে প্রায় ১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা এক বছর আগে ঘাটতিতে ছিল।
স্থিতিশীল হয়েছে ডলারের বাজার
দীর্ঘ অস্থিরতার পর মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। গত বছর ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকায় গিয়েছিল। তবে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরে বাজার স্বাভাবিক হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে উল্টো বাজার থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে দাম ধরে রাখতে।
তবে অর্থনীতিতে রয়ে গেছে ঝুঁকি
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, কেবল রিজার্ভ বাড়লেই মূলধারায় ফেরা যাবে না।
-
মূল্যস্ফীতি: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে লক্ষ্য ছিল ৭ শতাংশে নামানো, কিন্তু তা দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশে।
-
বেকারত্ব: হার বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। দেশে বেকারের সংখ্যা এখন প্রায় ২৭ লাখ।
-
জিডিপি প্রবৃদ্ধি: কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে, যা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
-
বিনিয়োগ ও সঞ্চয়: জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ নেমে এসেছে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশে, সঞ্চয়ের হারও কমছে ধারাবাহিকভাবে।
-
ব্যাংক খাত: খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন সংকট বাড়ছে।
-
বিদেশি ঋণ: গত অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ রেকর্ড ছাড়িয়েছে ৪০০ কোটি ডলার।
পুঁজিবাজারে অস্থিরতা কাটলেও আস্থা ফেরেনি পুরোপুরি
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজারে স্বস্তি ফিরেছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। বাজার মূলধনও বেড়ে ৭ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন,
“রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও বিনিয়োগ, সঞ্চয় ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জে রেখেছে। কেবল টাকার জোগান নয়—এখন দরকার স্বচ্ছ নেতৃত্ব, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সময়োপযোগী অর্থনৈতিক নীতি।”
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন,
“অর্থনীতি ভঙ্গুর থাকলেও আগের তুলনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। নতুন সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পারলে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।”
উপসংহার
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে থাকলেও রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও রিজার্ভ বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগে আস্থা ফেরানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যকর নেতৃত্ব ছাড়া টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।