গিটারের তার তত্ত্ব ও বাংলাদেশের অর্থনীতি: পুনরুদ্ধারের পথে নাকি অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে?
প্রকাশের তারিখ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫
প্রবাস বুলেটিন ডেস্ক রিপোর্ট
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যানের বহুল আলোচিত তত্ত্ব ‘গিটার স্ট্রিং থিওরি অব রিসেশনস’ অনুযায়ী, অর্থনীতি অনেকটা গিটারের তারের মতো আচরণ করে। যখন কোনো মন্দা অর্থনীতিকে নিচে টেনে ধরে, তখন উৎপাদন, আয় ও কর্মসংস্থান কমে যায়; কিন্তু সংকট কেটে গেলে অর্থনীতি দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তবে এই তত্ত্বের ব্যতিক্রমও দেখা যায়—বিশেষ করে যখন মন্দা এত গভীর হয় যে অর্থনীতির কাঠামোগত ক্ষতি ঘটে, অর্থাৎ ‘তারটি ছিঁড়ে যায়’।
২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার পর প্রশ্ন ওঠে তত্ত্ব নিয়ে
২০০৮–০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময় দেখা যায়, অনেক দেশের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ফ্রিডম্যানের ব্যাখ্যার মতো দ্রুত হয়নি। বরং তা হয়েছে ধীর, দুর্বল ও অসম। অর্থনীতিবিদরা তখন বলেন, “গিটার স্ট্রিং তত্ত্ব সব সময় কাজ করে না, কারণ বাস্তবতা অনেক জটিল।”
বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র: ছিঁড়ে যাওয়া তারের গল্প
বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২০ সাল থেকে কার্যত মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে কোভিড–১৯ মহামারি এবং পরে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। তবে যখন বেশিরভাগ দেশই পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে, তখন বাংলাদেশ এখনো সেই ঘূর্ণাবর্ত থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এর জন্য দায়ী অতীত সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা—
-
দুর্নীতি ও অর্থপাচার,
-
অতিরিক্ত টাকা ছাপানো,
-
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা,
-
টাকার অবমূল্যায়ন এবং
-
রিজার্ভের দ্রুত পতন।
ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে কিছু অগ্রগতি
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমানে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ফলে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যও কিছুটা ফিরেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় এই উন্নতির পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
তবে অর্থনীতির মূল প্রাণ—বেসরকারি বিনিয়োগ—এখনো স্থবির।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.৩৮ শতাংশ, যা নতুন কর্মসংস্থান বা আয় বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত নয়।
মানুষের বাস্তব আয় কমেছে
সরকারি তথ্য বলছে, প্রকৃত আয় কমে গেছে এবং মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না। এ সময়ে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ফলে পরিবারগুলো চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে।
দারিদ্র্য বেড়েছে, সংকট আরও গভীর
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০২২ সালের তথ্যে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, তবে বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি জানাচ্ছে, বর্তমানে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশে।
এর পাশাপাশি আরও ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় দরিদ্র শ্রেণিতে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিনিয়োগহীনতার কারণ: অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে মূলত অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিকোলাস ব্লুম ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণা প্রাসঙ্গিক। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, “অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করে।” কারণ এতে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত, নতুন বিনিয়োগ ও ভোক্তা ব্যয়—সবই স্থগিত থাকে।
সমাধান: অনিশ্চয়তা দূর করে আস্থা ফিরিয়ে আনা
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন বাংলাদেশের প্রধান কাজ হলো—
-
অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা দূর করা,
-
আইনশৃঙ্খলা উন্নত করা,
-
দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি রোধ করা,
-
এবং বেসরকারি খাতের আস্থা পুনঃস্থাপন।
একটি অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শেষ কথা
মিলটন ফ্রিডম্যানের গিটারের তারের মতো বাংলাদেশ কি আবার আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে—নাকি ছিঁড়ে যাওয়া তারের মতো দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকবে, তা নির্ভর করছে আগামী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলোর ওপর। অনিশ্চয়তার ভার যদি না কমে, তবে ‘অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার’ কেবল নীতিপত্রে সীমাবদ্ধই থেকে যেতে পারে।

