কলকাতা: সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা উদয় শঙ্কর, মা অমলা শঙ্কর স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী। তাঁর জন্মের পর থেকেই যেন ঠিক হয়ে গিয়েছিল, তিনি বেছে নেবেন নাচকেই। হয়েছিল ও তাই। ছোট্ট মেয়েটি ভালবেসেই গ্রহণ করেছিল নৃত্যশিল্পকে। তারপরে অভিনয়.. একের পর এক দরজা খুলে গিয়েছে তাঁর সামনে। নাহ.. পারিবারিক সূত্রে নয়, নিজের জোরেই তিনি নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন, যে জায়গা এখনও সমানভাবে উজ্জ্বল। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে, বর্তমান প্রজন্মকে কীভাবে দেখেন তিনি? মনে পড়ে তাঁর নিজের কেরিয়ারের একেবারে শুরুর দিকের কথা? বাবা মায়ের দেওয়া শিক্ষার কথা? মূল্যবোধের কথা? নারী দিবসের আগে, নিজের কথা, শিক্ষার কথা, আত্মসম্মানের কথা শোনালেন মমতা শঙ্কর।
সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম, বাবা-মা স্বনামধন্য। কেরিয়ারের একেবারে শুরু থেকেই কী নৃত্যচর্চা শুরু হয়েছিল মমতা শঙ্করের? নৃত্যশিল্পী অভিনেত্রী বলছেন, ‘আমার বাবা, মা আমায় প্রথম যে শিক্ষাটা দিয়েছেন, সেটা হল মূল্যবোধের শিক্ষা। আমার মা ছিলেন আমার কেরিয়ারের সবচেয়ে কড়া শিক্ষিকা। কখনও মায়ের কাছে, বাবার কাছে প্রশংসা পাইনি। সবসময় বাবা-মা বলেছেন, ‘অন্য কেউ এসে বলবেন তোমার ভালটুকু। তবেই আমরা বুঝব, তুমি ভাল করছো’। বাবা মা প্রশংসা করতেন না বলেই বোধহয়, সবসময় ওই আরও ভাল কাজ করার খিদেটা মরে যায়নি। তবে হ্যাঁ, বাবা মাকে নাচ করতে দেখেছি খুব ছোট বয়স থেকেই। সেই থেকে আমার শেখা। তারপরে ১০ বছর বয়স থেকে প্রথাগতভাবে নাচ শিখতে শুরু করি। এমন একটা পরিবারে আমার জন্ম, মনে করি এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। বাবা-মা দুজনেই নাচ করতেন। তারপরে আমিও যখন নাচকেই বেছে নিলাম, বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তারপরে অভিনয়। আমার সামনে এক একটা দরজা খুলে গিয়েছে, আর আমি এগিয়ে গিয়েছি। বিয়ে ও হল এমন একটা পরিবারে, যেখানে শিল্পকে সবসময় এগিয়ে রাখা হয়েছে। আমি শুধু নিজের বিবেককে সঙ্গে নিয়ে সোজাপথে হেঁটে গিয়েছি। কোনোও দিকে না তাকিয়ে। মমতা শঙ্কর কোনোদিন হতে পারব কি না.. মমতা শঙ্কর কে, কী.. আমি জানি না।’
নৃত্যশিল্প থেকে অভিনয়, পুরো পথটাই কী কুসুমাস্তীর্ণ ছিল মমতা শঙ্করের কাছে? শিল্পী বলছেন, ‘আমি খালি আমার সতততাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে গিয়েছি। নৃত্য থেকে অভিনয়, কখনও আমায় খারাপ কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি। কোনও বাধার সামনে পড়তে হয়নি। কোনও খারাপ মানুষের সামনেও পড়তে হয়নি। কোনো কিছুতেই আমি কোনও অভিযোগ করতে পারব না।’ বর্তমানে শিল্পীদের থেকে বিভিন্ন অভিযোগ উঠে আসে বিভিন্ন সময়ে। অনেকেই অপ্রিয় প্রস্তাবের সম্মুখীন হন। জীবনে কখনও এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি মমতা শঙ্করকে। কারণ হিসেবে শিল্পীর কথায়, ‘নিজের আত্মসম্মান আর আত্মমর্যাদাবোধটা ধরে রাখতে হবে। আমি এমন অনেক মানুষের কথা শুনেছি, যখন আমায় কেউ এসে বলেছেন.. ‘উনি তোমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সাংঘাতিক লোক কিন্তু, খুব সাবধানে থেকো।’ আমি সবসময়েই বলেছি, ‘কেন? আমার তো ওঁকে ভীষণ সজ্জন, ভদ্র আর ভাল মানুষ বলেই মনে হল।’ আমরা গভীর রাত পর্যন্ত শ্যুটিং করেছি। এরকম কত মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসে আড্ডা দিয়েছি, গান গেয়েছি। কিন্তু কখনও কেউ কোনওরকম খারাপ প্রস্তাব দেওয়ার কথা ভাবতেও পারেননি। নিজের চারপাশে যদি একটা ব্যক্তিত্বের বেড়াজাল রাখা যায়, তাহলে কোনোদিন কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। সে যদি নিজে শক্ত থাকে। এবং আমি নতুন প্রজন্মকে বলব, যদি কখনও কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে নিজের বুদ্ধির জোরে কীভাবে সেটাকে কাটিয়ে যাওয়া যায়, সেটাও জানতে হবে।’
বর্তমান প্রজন্ম কী সেই বেড়াজাল রাখতে পারছে না বলেই এত কাদা ছোঁড়াছুড়ি? মমতা শঙ্কর বলছেন, ‘মানুষের লোভ বাড়ছে এবং চাহিদা বাড়ছে। আমার মনে হয়, চাহিদাটাকে যদি সীমিত রাখা যায়, আর লোভকে যদি দূরে সরিয়ে রাখা যায়, তাহলে অনেক কিছুর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা যায়। আমার বাবা মা ছোটবেলা থেকে বলে এসেছেন, ‘নাম আর টাকার পিছনে ছুটো না। কাজ করে যাও, নিজের সততা বজায় রাখো.. সব আসবে। কিন্তু তুমি সেগুলোর পিছনে ছুটতে গেলে সব দূরে চলে যাবে।’ আমি সেটাই মেনে চলেছি। আমার চাহিদা অত্যন্ত কম। আমি কোনোকিছুর জন্য লোভ করি না। আমি সবসময় মনে করি, আমার যতটুকু পাওয়ার বা করার আমি ততটুকুই পাব বা করতে পারব। হয়তো কোনো সিনেমার চরিত্র আমার হাতের কাছে এসেও চলে গেল। মনে হয়, ঠিক আছে.. এটা আমার জন্য ছিল না। যে করে হোক আমায় পেতেই হবে, আমায় করতেই হবে এই ব্যপারটা আমার মধ্যে নেই। আমার মনে হয়, যেটা আমার প্রাপ্য সেটা আমার কাছেই আসবে। এটাই যদি পরের প্রজন্ম মনে রাখে, তাহলে জীবনটা অনেক সুন্দর এবং সহজ হয়ে যাবে।’