প্রকাশের তারিখ: সোমবার, ৬ অক্টোবর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা
কানাডার বহুল আলোচিত ‘বেগমপাড়া’ ইস্যু আবারও আলোচনায় এসেছে। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একাংশের অবৈধ সম্পদ পাচার এবং সেই অর্থে কানাডায় বিলাসবহুল জীবনযাপনের বিষয়টি ২০২০ সালেই প্রথম আলোচনায় আসে। এবার সেই পুরোনো তালিকায় যোগ হয়েছে আরও কিছু নতুন নাম ও সম্পদের তথ্য।
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন— “রাজনৈতিক ব্যক্তির চেয়ে সরকারি কর্মকর্তারাই বেশি অর্থ পাচার করেছেন।” তিনি বলেন, কিছু ব্যবসায়ীও এই চক্রে জড়িত ছিলেন।
হাইকোর্টের নির্দেশ ও তদন্তের গতি রোধ
সেই সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারের কাছে ২৮ জনের একটি তালিকা চায়। পরবর্তীতে হাইকোর্ট বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সম্পূর্ণ তথ্য জমা দিতে নির্দেশ দেয়। দুদক জানায়, শতাধিক ব্যক্তি প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়া রাজনৈতিক চাপে পরে কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
তালিকায় কারা আছেন
তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বেশিরভাগই সাবেক আমলা ও প্রভাবশালী কর্মকর্তা। উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন—
-
ড. আহমদ কায়কাউস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব — মন্ট্রিল ও টরন্টোয় ৪টি বাড়ির মালিক।
-
আবু আলম শহীদ খান, সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব (বর্তমানে কারান্তরিন) — টরন্টোয় বাড়ি রয়েছে।
-
আবুল কালাম আজাদ, সাবেক মুখ্য সচিব — টরন্টোয় ৩টি ফ্ল্যাট।
-
নজিবুর রহমান, সাবেক মুখ্য সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান (কারাবন্দি) — মিসিসাগায় ২টি বিলাসবহুল বাড়ি।
-
ড. ইকবাল মাহমুদ, সাবেক দুদক চেয়ারম্যান — কানাডায় ৩টি বাড়ি।
-
মহিবুল হক, সাবেক বিমান সচিব — ৩টি অ্যাপার্টমেন্ট।
-
ফজলে কবির, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক — মন্ট্রিলে ২টি ফ্ল্যাট।
-
আবদুর রউফ তালুকদার, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক — টরন্টোয় ৫টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট।
-
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সাবেক সচিব — মন্ট্রিলে ৩টি বাড়ি।
-
প্রশান্ত কুমার হালদার, সাবেক ব্যাংকার — ৩টি ফ্ল্যাট।
-
নাফিস সরাফত, ব্যবসায়ী — ৪টি ফ্ল্যাট ও বিনিয়োগ।
-
শহীদ ইসলাম পাপলু, সাবেক এমপি — ৩টি বাড়ি ও বিনিয়োগ।
-
নজরুল ইসলাম মজুমদার, নাসা গ্রুপ চেয়ারম্যান — ৪টি বাড়ি ও বিনিয়োগ।
-
বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি — মেয়ের নামে ২টি বাড়ি।
-
বিচারপতি এস কে সিনহা, সাবেক প্রধান বিচারপতি — মেয়ের নামে ১টি ফ্ল্যাট।
-
শাহরিয়ার আলম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী — ৩টি বাড়ি ও বিনিয়োগ।
এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাদের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ীর পরিবারের নামে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ।
প্রবাসীদের ক্ষোভ
কানাডায় অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, এসব ব্যক্তি অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে বিদেশে রাজকীয় জীবনযাপন করছেন, অথচ তাদের বৈধ আয়ের উৎস নেই। এতে স্থানীয় প্রবাসী সমাজে ক্ষোভ ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সরকারি অবস্থান
২০২০ সালে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক শেষে তৎকালীন সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, বিদেশে অর্থ পাচার সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা কাজ করছে। তবে পরবর্তীতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি।
উপসংহার:
‘বেগমপাড়া’ এখন কেবল একটি ভৌগোলিক জায়গা নয়, বরং বাংলাদেশের দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রবাসী ও দেশবাসীর দাবি— অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যাতে রাষ্ট্রের অর্থ আর কোনোদিন বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে।
সূত্র: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আদালতের নথি ও প্রবাসী সূত্র

