নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদী, ৩০ মে ২০২৫
বৃষ্টি মানেই একরাশ কষ্ট আর নাগরিক বিড়ম্বনা—এ যেন পুরোনো কথা। তবে সেই পুরোনো কথাই প্রতিদিন নতুন করে অনুভব করতে হয় শহরের হাজারো মানুষের মতো আমাদের শিক্ষক সমাজকেও। বৃহস্পতিবার (২৯ মে) সকাল থেকেই টানা বৃষ্টির কারণে চরম দুর্ভোগের শিকার হন নরসিংদীর সাটিরপাড়া কালীকুমার ইনস্টিটিউশনের এক অতিথি শিক্ষিকা। তার সেই সকালটা ছিল শুধুই ভেজা কাপড় আর প্যাঁচাল কাদার সঙ্গে একটানা যুদ্ধের নাম।
স্কুলে সকাল ৯টার মধ্যে পৌঁছাতে হয় তাকে। কিন্তু সকালেই ঝুম বৃষ্টির কারণে তৈরি হয় কঠিন পরিস্থিতি। ছাতা হাতে রওনা দিলেও দেখা যায়, রাস্তায় নেমে শুরু হলো আরেক ধাপের যুদ্ধ—কাদা, যানজট আর অতিরিক্ত ভাড়ার অজুহাত। বৃষ্টির কারণে অটোরিকশা পাওয়া কঠিন, আর যারা আছে, তারা চায় দ্বিগুণ ভাড়া। শেষ পর্যন্ত অনেক অপেক্ষা ও দর-কষাকষির পর একটি অটোরিকশায় উঠতে সক্ষম হন তিনি।
তবে দুর্ভোগ এখানেই শেষ নয়। অটোরিকশায় চলতে গিয়ে পৌরসভার মোড়ে পৌঁছেই আটকে পড়েন বিশাল যানজটে। সকালবেলা যখন অফিসগামী মানুষের ভিড় থাকে, তখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাস্তার ওপর থেমে থাকা মালবাহী ট্রাক ও একাধিক ছোটখাটো সংঘর্ষের দৃশ্য। একটি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের তর্কাতর্কিতে পুরো মোড়ে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। পুলিশ এলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়।
ঘড়ির কাঁটা তখন ছুঁইছুঁই করছে স্কুল শুরুর সময়। শিক্ষক হওয়ার দায়িত্ববোধ আর সময়মতো ক্লাসে উপস্থিত থাকার অদম্য চেষ্টা নিয়ে তিনি এগিয়ে চলেন। হোসেন মার্কেট এলাকায় এসে অটোরিকশাচালক জানিয়ে দেন, আর এগোনো সম্ভব নয়, গাড়ির চার্জ নেই, সামনে যানজট। বাধ্য হয়ে শুরু করেন পায়ে হাঁটা। রাস্তায় পানি জমে থাকায় ভিজে যেতে হয় কাপড়চোপড়। এমনকি রজনীগন্ধা চত্বর পার হওয়ার সময় এক মোটরসাইকেল চালকের পানির ছিটায় পুরো বোরকাও ভিজে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে চালক একবারও পেছনে ফিরে তাকাননি।
সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে যখন তিনি স্কুলে পৌঁছান, তখন ঘড়িতে ৯টা ৮ মিনিট। শিক্ষক কক্ষে গিয়ে নিজেই ব্যাগ থেকে আরেকটি বোরকা বের করে পরিবর্তন করে দ্রুত ক্লাসে ঢুকে পড়েন। দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ তার নেই। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখেন, অনেক শিক্ষক তখনো আসেননি। এমনকি কেউ কেউ আসতে পারেননি যানবাহনের অভাবে।
এই অভিজ্ঞতা শুধু একজন শিক্ষিকার নয়, বরং পুরো নাগরিক ব্যবস্থার প্রতিফলন।
নগর পরিকল্পনার দুর্বলতা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা ও অবহেলিত অবকাঠামো যেন প্রতিদিন সাধারণ নাগরিকদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত নারী পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে এটি হয় আরও জটিল, যখন নিরাপত্তা, সময়ানুবর্তিতা এবং দায়িত্ববোধ একসঙ্গে সামলাতে হয়।
নগরবাসীর দুর্ভোগ শুধু যানজট বা বৃষ্টির মধ্যে আটকে পড়া নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি অব্যবস্থাপনার ফল। উন্নয়ন প্রকল্প, শহর ব্যবস্থাপনা এবং গণপরিবহন পরিকল্পনায় সমন্বয় না থাকলে এমন ভোগান্তির চিত্র প্রতিদিনই সংবাদ শিরোনামে থাকবে। একজন শিক্ষক যখন বৃষ্টিভেজা রাস্তায় লড়াই করে স্কুলে পৌঁছান, তখন সেটা কেবল ব্যক্তিগত গল্প নয়—একটি বৃহত্তর সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন।