লিখেছেন: সারফুদ্দিন আহমেদের অনুবাদ থেকে সম্পাদিত | সূত্র: আল জাজিরা
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ চতুর্থ দিনে গড়িয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতে। দুই পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই হামলার প্রেক্ষাপট, কৌশল এবং ইসরায়েলি সরকারের দাবিগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নের মুখে পড়েছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।
ইসরায়েলের ‘প্রতিরোধমূলক’ দাবি কতটা গ্রহণযোগ্য?
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় চালানো হামলা ছিল ‘প্রতিরোধমূলক’। তাদের ভাষ্য মতে, ইরান খুব শিগগিরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে—এমন হুমকি মোকাবিলাই ছিল এই হামলার মূল উদ্দেশ্য। তবে এই দাবির পক্ষে ইসরায়েল কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) ১২ জুন যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে এমন কোনো তথ্য উঠে আসেনি যা এই হামলার জরুরি ভিত্তি প্রমাণ করতে পারে। বরং, এটি প্রতীয়মান যে, ইসরায়েলের এই অভিযান ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ।
আসল লক্ষ্য কী ছিল?
যদিও ইসরায়েল বলছে—এই হামলার মাধ্যমে তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছে, কিন্তু হামলার প্রকৃতি এবং যেসব স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে, তা ইঙ্গিত দেয় আরও বৃহৎ কৌশলের দিকে। মিসাইল ঘাঁটি, গ্যাস ও তেল ডিপো, এমনকি সরকারি অফিস ও সামরিক সদরদপ্তরে একের পর এক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো—ইরানের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা আলী শামখানির হত্যাকাণ্ড। তাঁর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কয়েকজন ব্যক্তিও নিহত হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই হত্যা কেবল একটি সামরিক পদক্ষেপ নয়, বরং কৌশলগত আলোচনার টেবিলে ইরানের অবস্থান দুর্বল করাই ছিল ইসরায়েলের লক্ষ্য।
‘শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন’ কি মূল উদ্দেশ্য?
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি ইরানি জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন বর্তমান ‘দমনমূলক শাসনব্যবস্থার’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। এটি স্পষ্টত একটি রাজনৈতিক বার্তা। ইসরায়েল মনে করছে, এই হামলার মাধ্যমে ইরানে গণ-বিদ্রোহ উসকে দেওয়া যাবে।
তবে বাস্তবতা হলো—ইরানে বহু মানুষ ইসলামিক রিপাবলিকের বিরোধী হলেও, অধিকাংশ ইরানি বিদেশি হস্তক্ষেপ ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। ফলে এমন ধারণা যে, কেবলমাত্র হামলার মাধ্যমে তারা শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে, সেটি ইরানের বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট না বোঝারই নামান্তর।
হামলার সময় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই মুহূর্তে গাজায় চলমান যুদ্ধ, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার প্রস্তুতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক চাপ—সবকিছু মিলে ইসরায়েলের ওপর নজিরবিহীন চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই সময়েই ইরানে একতরফা হামলা চালানো নিঃসন্দেহে একটি কৌশলগত চাল, যার লক্ষ্য দৃষ্টি ঘোরানো।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি নেতানিয়াহুর একটি মরিয়া চেষ্টা—একদিকে আন্তর্জাতিক দায়মুক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, অন্যদিকে নিজেকে রাজনৈতিক ও আইনি সংকট থেকে রক্ষা করা। নেতানিয়াহু বহু বছর ধরেই এই হামলার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল।
‘নিরাপত্তা’ শব্দের অন্তরালে আধিপত্যবাদ?
ইসরায়েলের প্রতিটি আক্রমণের পেছনে নিরাপত্তার অজুহাত থাকলেও, সেই নিরাপত্তার ধারণা আসলে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার রূপ নিচ্ছে। গাজা, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, আর এখন ইরান—প্রতিটি জায়গায় ইসরায়েল একই যুক্তি তুলে ধরে হামলা চালিয়েছে। এই ধারণা যদি আন্তর্জাতিকভাবে চ্যালেঞ্জ না হয়, তবে এই সংঘাত কেবল বাড়তেই থাকবে।
উপসংহার
ইরানে এই হামলা নিছক প্রতিরোধমূলক নয়, এটি নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক বাঁচার চেষ্টা ও ইসরায়েলের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমের প্রক্রিয়ার অংশ। ইসরায়েলের এই কৌশল শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে—তা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক শক্তি এবং অবশ্যই ইরানি জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর।