তুষার আহমেদ | ঢাকা | ১৭ জুন ২০২৫
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইতিমধ্যে উভয় দেশের পাল্টাপাল্টি হামলায় প্রাণহানি ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতে শুরু করেছে। এই সংঘাত যদি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কেবল ওই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না—গভীর অভিঘাত দেখা দেবে বৈশ্বিক অর্থনীতি, জ্বালানি বাজার ও সরবরাহ শৃঙ্খলেও। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে।
হরমুজ প্রণালির শঙ্কা: বিশ্বজুড়ে জ্বালানি অস্থিরতা
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ হরমুজ প্রণালি, যার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়—যা বিশ্ব সরবরাহের ২০ শতাংশের মতো। এই পথ সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম রেকর্ড হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ কিংবা ২০১৭ সালে সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় হামলার সময়ও তেলের দাম তীব্রভাবে বেড়েছিল।
বাংলাদেশে তাৎক্ষণিক প্রভাব: ব্যয় বাড়বে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদনে
বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর জ্বালানি অর্থনীতি। এলএনজি ও পরিশোধিত তেলেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ নির্ভরশীল। কাতার ও ওমান থেকে আমদানি হওয়া এলএনজির একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। এই পথ বন্ধ হলে গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
ফলে—
-
বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে
-
শিল্প উৎপাদনে প্রভাব পড়বে
-
পরিবহন ও কৃষিতে খরচ বাড়বে
-
সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি আরও তীব্র হবে
এরই মধ্যে দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এখন যদি জ্বালানির দাম আরও বাড়ে, তাহলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে এবং দারিদ্র্য আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডলার সংকটের আশঙ্কা: বাড়বে আমদানি ব্যয়, চাপ রিজার্ভে
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এতে আবারও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে পড়বে।
সাথে—
-
টাকার মান দুর্বল হতে পারে
-
মূল্যস্ফীতি আরও তীব্র হতে পারে
-
মুদ্রানীতি কঠোর করলে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এমনিতেই এক ধরনের স্ট্যাগফ্লেশনে (উচ্চ মূল্যস্ফীতি + নিম্ন প্রবৃদ্ধি) রয়েছে। এই সংকটে যুদ্ধের অভিঘাত অর্থনীতিকে সংকোচনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
পোশাক রপ্তানি খাত ও বৈদেশিক বাণিজ্যও হুমকির মুখে
বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো তৈরি পোশাক খাত। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথে বিঘ্ন ঘটে, তবে—
-
পণ্য পরিবহনে বিলম্ব ঘটবে
-
অর্ডার বাতিল হতে পারে
-
মূল্যছাড় দিতে হতে পারে
-
বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে
এসব কারণেই বিশ্লেষকেরা পরিস্থিতিকে ‘গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন শক’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
প্রবাসী আয়ের প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে
মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার। যদি যুদ্ধ বিস্তৃত হয়, তাহলে—
-
নির্মাণ ও পরিষেবা খাত স্থবির হয়ে পড়তে পারে
-
কাজ হারাতে পারেন অনেক প্রবাসী
-
নতুন কর্মী নেওয়া স্থগিত হতে পারে
-
ফ্লাইট চলাচল ব্যাহত হলে যাতায়াত ব্যয় বাড়বে
ইরান থেকে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় নগণ্য হলেও ওমান বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এখানেও প্রভাব পড়বে।
আকাশপথে সাময়িক ঝুঁকি: বিমান চলাচলে সীমিত প্রভাব
ইরান–ইসরায়েল হামলার পরপরই ফ্লাইট ট্র্যাকিং সাইটগুলোতে দেখা গেছে, ইরানের আকাশ ফাঁকা হয়ে গেছে। ইউরোপ–এশিয়া রুটের অনেক বিমান মাঝ আকাশ থেকেই রুট পরিবর্তন করেছে।
বাংলাদেশের হাতে গোনা কিছু ফ্লাইট ইরানের আকাশ ব্যবহার করলেও এখনই বড় প্রভাব পড়বে না। তবে টিকিটের দাম না বাড়লেও সূচি পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে।
বিশেষজ্ঞের মতামত: বিকল্প উৎস ও বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী চাপ সৃষ্টি করবে।
তিনি বলেন,
“জ্বালানি সংকট, রপ্তানি বাধা ও রেমিট্যান্স হ্রাস একত্রে মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি—দুই দিকেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এখন থেকেই আমাদের বিকল্প জ্বালানির উৎস, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ, এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।”
উপসংহার
ইরান–ইসরায়েল সংঘাত এখন আর কেবল দুই দেশের মধ্যকার বিষয় নয়। এর গতি–প্রকৃতি আন্তর্জাতিক বাজারকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর ও রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এ যুদ্ধ এক বড় ধরনের বহুমাত্রিক হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনই সরকার, নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের এই প্রেক্ষাপটে প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।