ঐতিহাসিক বিরোধে প্রাণ গেল ৩২ জনের, উত্তেজনায় কূটনৈতিক সম্পর্ক বিপর্যস্ত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রবাস বুলেটিন | ২৬ জুলাই ২০২৫
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার শতবর্ষের পুরোনো সীমান্ত বিরোধ আবারও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয়পক্ষে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩২ জন, আহত হয়েছেন ১৩০ জনের বেশি। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন চরম উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নেমেছে জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো।
🔥 কী ঘটেছে সাম্প্রতিক সংঘাতে?
গত বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর বিমান হামলা চালায়। পাল্টা জবাবে কম্বোডিয়া রকেট ও কামান ব্যবহার করে সীমান্তে হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে। উভয় দেশই একে অপরকে সংঘর্ষ শুরু করার দায়ে অভিযুক্ত করছে।
এরই মধ্যে কম্বোডিয়ার প্রেয়াহ বিহার প্রদেশ ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী আটটি জেলায় সামরিক আইন জারি হয়েছে। থাইল্যান্ড প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে। কম্বোডিয়াও ২০ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়েছে।
🗺️ দীর্ঘদিনের বিরোধ: শিকড় এক শতাব্দী পেছনে
সীমান্ত নিয়ে বিরোধের শুরু ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে (১৯০৭)। ফ্রান্সের তৈরি করা মানচিত্র নিয়ে তখন থেকেই বিতর্ক চলে আসছে।
সম্পূর্ণ সীমান্তজুড়ে (৮১৭ কিমি) এখনও কোনো নির্ভরযোগ্য demarcation হয়নি। ফলে বিতর্কিত অঞ্চলগুলোতে প্রায়ই উত্তেজনা দেখা দেয়।
💣 উত্তেজনার পেছনে সাম্প্রতিক কারণ
-
মে ২০২৫: সীমান্তে গোলাগুলিতে এক কম্বোডিয়ান সেনা নিহত।
-
বুধবার (২৩ জুলাই): থাইল্যান্ডের পাঁচ সেনা মাইনে আহত।
-
থাইল্যান্ড: সীমান্ত বন্ধ করে, রাষ্ট্রদূত বহিষ্কার করে।
-
কম্বোডিয়া: থাই পণ্য নিষিদ্ধ করে, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেয়।
🧭 রাজনৈতিক বাস্তবতা ও দ্বিপক্ষীয় টানাপোড়েন
কম্বোডিয়া:
কম্বোডিয়ায় কার্যত একদলীয় শাসন চলছে। দেশটি প্রায় চার দশক ধরে শাসন করেছেন হুন সেন। ২০২৩ সালে তিনি ছেলেকে (হুন মানেত) ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘাতে জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়ে হুন সেন ছেলের অবস্থান মজবুত করতে চান।
থাইল্যান্ড:
থাইল্যান্ডে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা সাময়িক বরখাস্ত। তাঁর বিরুদ্ধে সীমান্ত ইস্যুতে দুর্বল প্রতিক্রিয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সাম্প্রতিক এক ফাঁস হওয়া অডিওতে পেতংতার্নকে হুন সেনকে ‘আঙ্কেল’ সম্বোধন করতে শোনা যায়। এতে থাই সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
⚠️ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মধ্যস্থতার সম্ভাবনা
কম্বোডিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে। মালয়েশিয়া ও আসিয়ানের পক্ষ থেকে উভয় দেশকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসিয়ান ঐতিহ্যগতভাবে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা’র নীতিতে বিশ্বাসী, তাই এর পক্ষ থেকে কার্যকর মধ্যস্থতার সম্ভাবনা কম।
বিশেষজ্ঞ তিতা সাংলি মনে করেন, একমাত্র চীন উভয় দেশের ওপর প্রভাব খাটিয়ে মধ্যস্থতার চেষ্টা করতে পারে। তবে চীনের ঘনিষ্ঠতা মূলত কম্বোডিয়ার সঙ্গে বেশি হওয়ায় থাইল্যান্ড এতে অস্বস্তি বোধ করতে পারে।
💼 অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ: আরেকটি গোপন উদ্দেশ্য?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উভয় দেশের সরকার আন্তর্জাতিক বাজারে আসন্ন ৩৬ শতাংশ শুল্কের চাপ থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতেই এই উত্তেজনা কাজে লাগাতে পারে।
কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড উভয়েই আগামী ১ আগস্ট থেকে মার্কিন বাজারে এই শুল্কের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, যা তাদের রপ্তানির ওপর বড় ধাক্কা হতে পারে।
🔚 সমাধান কী?
কম্বোডিয়া দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) মাধ্যমে বিরোধের মীমাংসা চাইলেও থাইল্যান্ড তা মানতে নারাজ।
থাইল্যান্ডের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচাইয়াচাই বলেন,
“আলোচনার আগে লড়াই থামাতে হবে। এখনো যুদ্ধ ঘোষণা হয়নি।”
সুতরাং সংকট সমাধানের পথ জটিল ও অনিশ্চিত।