মঙ্গলবার, ২১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

📍 ঢাকা | ৩১ জুলাই ২০২৫
✍️ প্রবাস বুলেটিন

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান দমনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জবানবন্দিতে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তাঁর পাঁচ পৃষ্ঠার এ জবানবন্দিতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গুম, গোপন বন্দিশালা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার থেকে গুলির মতো গুরুতর অভিযোগ উঠে এসেছে।

২০২২ সাল থেকে শেখ হাসিনার সরকারের শেষ পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্ব পালন করা মামুন বর্তমানে কারাগারে আছেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ‘রাজসাক্ষী’ (approver) হিসেবে এই জবানবন্দি দিয়েছেন।


রাজনৈতিক নির্দেশে হেলিকপ্টার থেকে গুলি

জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের জুলাই-অভ্যুত্থান দমনের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়া হয়। এ পরিকল্পনা র‍্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশিদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়, যার সহযোগিতা করে সেনাবাহিনী।

“আমি পরে জানতে পারি, এটি ছিল গোপন রাজনৈতিক পরিকল্পনা। আমি পুলিশের প্রধান হিসেবে এই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না,” — বলেন মামুন।


প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

জবানবন্দিতে উঠে আসে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশেই আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।

“১৮ জুলাই ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চায়নিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দেন।”

তিনি আরও জানান, ব্লক রেইডের মাধ্যমে আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোয় দমন চালানো হয়।


প্রতিদিন রাতের গোপন বৈঠক

জুলাই আন্দোলন দমন কৌশলের অংশ হিসেবে প্রতিরাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হতো, যা শুরু হয় ১৯ জুলাই থেকে। এতে নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকতেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন:

  • স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর

  • অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) টিপু সুলতান

  • এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম

  • ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান

  • ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ

  • এনটিএমসি ও ডিজিএফআই প্রধান

  • র‍্যাব ও আনসারের মহাপরিচালক


সরকারি নির্দেশে গুম ও টেলিভিশনে মুচলেকা

জবানবন্দিতে বলা হয়, কোর কমিটির এক বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর তাঁদের ডিবির হেফাজতে নেওয়া হয়, মানসিক নির্যাতন করা হয় এবং টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়।

“আমি এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তা বাস্তবায়িত হয়,” — বলেন মামুন।


৪ আগস্ট শেখ হাসিনার দুই বৈঠক

সরকার পতনের আগের দিন, ৪ আগস্ট ২০২৪— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দফায় জরুরি বৈঠক করেন। প্রথমে সকাল ১১টায় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের কৌশল নির্ধারিত হয়। রাতে দ্বিতীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ঢাকার প্রবেশমুখে ফোর্স মোতায়েনের।

“৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী কোনো বাধা দেয়নি, বরং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে আমি বুঝি সরকার পতনের সময় এসেছে,” — বলেন মামুন।


রাতের ভোট: ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে ফাঁস

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে সাবেক আইজিপি বলেন, ব্যালট বাক্সে আগের রাতে ৫০% ব্যালট ভরে রাখার পরামর্শ দেন তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী। রাজনৈতিক নির্দেশে পুলিশ ও প্রশাসন মিলেই এই কাজ করে।


গুম ও গোপন বন্দিশালার স্বীকৃতি

মামুন জানান, র‍্যাবের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় গুম ও গোপন বন্দিশালা সম্পর্কে জানতেন। উত্তরার র‍্যাব-১ কমপ্লেক্সে টিএফআই সেল ছিল, যেখানে অনেককে বিনা বিচারে আটক রাখা হতো।

ব্যারিস্টার আরমানের ব্যাপারে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই আটক হন এবং তাঁকে টিএফআইতে রাখা হয়েছিল।

“র‍্যাবের এসব কার্যক্রম অনেক সময় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর অথবা নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের নির্দেশে হতো।”


ক্ষমা প্রার্থনা

জবানবন্দির শেষ অংশে সাবেক আইজিপি বলেন,

“সরকারের নির্দেশে এবং অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের কারণে জনগণের ওপর গুলি চালানোসহ দমন-পীড়নের ঘটনায় আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আমি ইতিহাসের কাছে সত্য তুলে ধরার জন্য এই জবানবন্দি দিচ্ছি।”

Leave A Reply

বৈদেশিক কর্মসংস্থান, অভিবাস ও প্রবাস জীবন সংক্রান্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল।

যোগাযোগ

সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্স (১১তম ফ্লো), রুম ১২/৮, ৬৭, নয়াপল্টন, ভিআইপি রোড, ঢাকা-১০০০, ফোন: +৮৮০ ১৫৩৩-১৯০৩৭১, ইমেইল: info@probashbulletin.com

Exit mobile version