নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা | ১৭ জুন ২০২৫
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ঘোষিত মেয়র হলেও এখনও শপথ নেননি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। তবে শপথ ছাড়াই তিনি নগর ভবনে ঢুকে মতবিনিময় সভা করেছেন, কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করছেন, এমনকি মেয়রের নামেই ব্যানারেও তাঁর পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিচার ও প্রশাসনিক জটিলতা, সৃষ্টি হয়েছে আইনশৃঙ্খলা ও দায়িত্ব জট।
সোমবার (১৬ জুন) দুপুরে নগর ভবনের মোহাম্মদ হানিফ মিলনায়তনে ইশরাক পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকদের সঙ্গে এক সভা করেন। সভার ব্যানারে তাঁকে “মাননীয় মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন” হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে প্রায় ৭০ জন পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক ও বিএনপি-সমর্থিত কয়েকজন সাবেক কাউন্সিলর অংশ নেন।
আইন লঙ্ঘন ও প্রশাসনিক প্রশ্ন
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শপথ না নিয়ে যেভাবে ইশরাক মেয়রের ‘দায়িত্ব পালন’ শুরু করেছেন, তা সরাসরি আইন লঙ্ঘনের শামিল। তাদের মতে, শপথ গ্রহণ না করলে কোনো জনপ্রতিনিধি দায়িত্ব পালন করতে পারেন না, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো দাপ্তরিক সভাও করতে পারেন না।
এই বিষয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “এটি অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতি। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন ছিল এবং সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন মেয়র নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু শপথ ছাড়াই মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার মতো ঘটনা দায়িত্বহীন ও আইনবহির্ভূত।”
নগর ভবনে অচলাবস্থা, বন্ধ প্রশাসনিক কার্যক্রম
গত ১৪ মে থেকে ইশরাকের সমর্থকরা ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে নগর ভবনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার পর থেকেই নগর ভবনের দাপ্তরিক কার্যক্রম কার্যত বন্ধ। শুধু মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালু রয়েছে। অফিস করতে পারছেন না কর্মকর্তারা।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “সব ধরনের উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এই অচলাবস্থার ভয়াবহ প্রভাব অচিরেই পরবে।” ঈদের ছুটির পর ১৫ জুন থেকে আন্দোলন আবারও জোরদার হয়েছে।
ইশরাকের অবস্থান ও দাবি
সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইশরাক বলেন, “নামপত্রে মেয়র লেখা হচ্ছে জনগণের দাবিতে। আমি গেজেটভুক্ত বৈধ মেয়র। গায়ের জোরে নয়, সাংবিধানিকভাবে আমি মেয়র।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাকে শপথ করতে দেবে না। অথচ সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ গেজেট স্থগিত করেনি। নির্বাচন কমিশনও তাদের কাজ শেষ করেছে।”
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ইশরাক ১৮ জুন ওয়ার্ড সচিবদের সঙ্গে এবং ১৯ জুন মশকনিধন সুপারভাইজারদের সঙ্গে সভা করবেন।
বিশেষজ্ঞ মত: খারাপ নজির স্থাপন
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “এভাবে শপথ ছাড়াই দাপ্তরিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া দায়িত্বহীন ও অনভিপ্রেত। এটি খারাপ নজির স্থাপন করছে। সরকার ও বিএনপি উভয়েরই উচিত দ্রুত সমাধান বের করা।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে, আদালত স্থগিত করেনি—এই ফাঁকেই যেন প্রশাসন জিম্মি হয়ে আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্লিপ্ত অবস্থানও সমালোচনার যোগ্য।”
নির্বাচনী প্রেক্ষাপট
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ডিএসসিসি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন ইশরাক হোসেন। ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ একটি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল তাঁকে জয়ী ঘোষণা করে। এরপর নির্বাচন কমিশন ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে। তবে শপথের বিষয়টি আটকে আছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জটিলতায়।
অবশেষে, নগরবাসীর প্রশ্ন: আইন, গেজেট ও রাজনৈতিক বাস্তবতার টানাপোড়েনে ঢাকার শহর কি তবে হয়ে পড়বে অচল?
এ প্রশ্নের জবাব সময়ই দেবে।