রিপোর্ট: নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশকাল: ২২ জুন ২০২৫ | সময়: বিকেল ৩:০০
ভোটের প্রস্তুতি পুরোদমে, তবে দিনক্ষণ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি
রোজার আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে—এমন সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও তা ঘিরে এখনো রয়েছে নানা জল্পনা, সংশয় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে ভোট কবে হবে—সে বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত ঘোষণা নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ওপর, যাঁর অবস্থান এখনো ধোঁয়াশাপূর্ণ।
নির্বাচনের আগে প্রস্তুতির হাওয়া
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দল আসন্ন নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাই কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিএনপির একাধিক নেতাকে প্রতিটি আসনে প্রস্তুত রাখা হয়েছে, আর জামায়াত ইতোমধ্যে ২০০টির বেশি আসনে প্রার্থী নামিয়ে ফেলেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৩০০ আসনেই প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এনসিপিও আজ নির্বাচন কমিশনে দল নিবন্ধনের আবেদন জমা দিতে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: নির্বাচন নিয়ে ‘যদি-কিন্তু’
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, “সংস্কারের অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হয়েছে, কিছু বিষয়ে এখনো হয়নি। যথাযথ সংস্কার ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সনদ প্রণয়ন হলে রোজার আগেই নির্বাচন সম্ভব।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “শুধু নির্বাচন হলেই হবে না, সেটি হতে হবে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। এর মাধ্যমেই গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ খুলবে। সুষ্ঠু নির্বাচন অতীতেও হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই আমরা যদি চাই একটি টেকসই রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, তবে সুদূরপ্রসারী সংস্কার জরুরি।”
অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদের বিশ্লেষণ: মূল ইচ্ছা অজ্ঞাত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ মনে করেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনী সময়সীমা ঘিরে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। তাঁর মতে, “প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে একেক সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা এসেছে। কখনো বলেছেন, রোজার আগেই নির্বাচন হতে পারে, আবার বলেছেন ২০২৬ সালের রমজানের আগের সপ্তাহেও হতে পারে। এই দ্বৈত বক্তব্য থেকে তাঁর চূড়ান্ত অবস্থান বোঝা যাচ্ছে না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এনসিপিকে প্রস্তুতির সময় দিতে হতে পারে। ভোটার তালিকা নিয়েও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তফসিল ঘোষণার আগে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে না পারলে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। সবকিছুই এখনো নির্ভর করছে প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর।”
নির্বাচন কমিশনের অবস্থান: ‘সরকারের ভাব বুঝতে হবে’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ১৬ জুন বলেন, “নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে এখনো সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা প্রস্তুত থাকব, তবে সময় নির্ধারণের বিষয়ে সরকারের ‘ভাব’ বুঝতে পারলেই চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে।”
রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট: একে অপরের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন
লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক এবং যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় জানানোয় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জামায়াত বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এনসিপিও বলেছে, বিদেশের মাটিতে নির্বাচনী আলাপ দেশের জন্য নেতিবাচক বার্তা দেয়।
অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ভোট হলে যাদের কোনো গুরুত্ব থাকবে না, তারাই এখন নির্বাচন ঘোষণা নিয়ে নাখোশ হয়েছে।”
সংস্কার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও ভাঙন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট। বিএনপি, গণফোরাম, সিপিবি এনসিসির বিপক্ষে, আর জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর পক্ষে মত দিয়েছে। সংলাপের মধ্যেই বিরোধ, বর্জন ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ঘটেছে।
সংস্কার না হলে নির্বাচন ফলপ্রসূ নয়: এনসিপি
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “আমরা মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার চাই। নির্বাচন নয়, প্রথমে শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির সংস্কার দরকার। তা না হলে সব কিছুই হবে লোক দেখানো।”
শেষ কথা: নির্বাচন নির্ভর করছে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্তের ওপর
নির্বাচনের সময় ঘিরে দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে, দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে দিনক্ষণ এখনও অনিশ্চিত। মূল সিদ্ধান্তের ভার রয়ে গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ওপর, যাঁর অবস্থান এখনো অস্পষ্ট এবং বিবিধ। ফলে আগামী নির্বাচন আদৌ রোজার আগেই হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উৎকণ্ঠা কমছে না।
সূত্র: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ, নির্বাচন কমিশনের ব্রিফিং, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের বক্তব্য, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ মতামত।
ছবি: সংগৃহীত/ফাইল ছবি
