নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রবাস বুলেটিন | জুলাই ২০২৫
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মার্কিন ডলারের মান ১০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে, যা ১৯৭৩ সালের পর ডলারের সবচেয়ে বড় পতন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর মুদ্রার বিপরীতে ডলারের এমন পতন আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় এক নতুন ধাক্কার আভাস দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ পরিস্থিতি শুধু বাজারের স্বাভাবিক ওঠানামা নয়—বরং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান, শুল্কনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর ক্রমাগত আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে
১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময় ডলার স্বর্ণমান থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আসে। এখন, ২০২৫ সালে, আরেকটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের মুখে পড়েছে ডলার, যদিও এবারের চালিকা শক্তি ভিন্ন—যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঋণ সমস্যা, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি, বিনিয়োগ আস্থা হ্রাস এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা।
ট্রাম্পের নীতির প্রভাব ও বাজারে প্রতিক্রিয়া
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আত্মকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি ও আগ্রাসী শুল্ক আরোপ বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ২ এপ্রিল ‘স্বাধীনতা দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্প উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ফলে:
-
শেয়ারবাজারে অস্থিরতা,
-
সরকারি বন্ডের চাহিদা হ্রাস এবং
-
ডলারের ওপর চাপ বেড়ে যায়।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড-এর বৈদেশিক মুদ্রা বিশ্লেষক স্টিভ ইংল্যান্ডার বলেন,
“ডলার শক্তিশালী না দুর্বল, সেটাই মুখ্য নয়। প্রশ্ন হলো, বিশ্ব এখন যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে দেখছে।”
ডলার দুর্বলতায় ভ্রমণ ব্যয় বাড়ছে, বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে
ডলারের মান কমে যাওয়ায়:
-
মার্কিন নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের খরচ বেড়েছে,
-
যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে,
-
রপ্তানিকারকেরা কিছুটা লাভবান, তবে আমদানির খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
তবে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার ফলে এমন মুদ্রাগত ভারসাম্য বজায় থাকাও এখন অনিশ্চিত।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ডলারের পতন মানে কেবল মূল্য নয়—এটি আস্থা ও নিয়ন্ত্রণের প্রতীকও। ফেডারেল রিজার্ভের নীতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ, উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা ও সরকারি ব্যয়ের লাগামহীন প্রবণতা—সব মিলিয়ে বিশ্ব এখন ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে।
বিশ্বের প্রধান পেনশন তহবিল ও তহবিল ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ ও এশিয়ার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ:
-
এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ২৪% বাড়লেও ইউরোয় হিসাব করলে তা মাত্র ১৫%।
-
ইউরোস্টক্স ৬০০ সূচক ইউরোপে ১৫% বৃদ্ধি পেলেও ডলারে রূপান্তর করলে তা ২৩% লাভে পরিণত হচ্ছে।
ডিডলারাইজেশন ও রুশ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ডলারের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে অনেক দেশ মনে করে, ডলার ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক লেনদেনে ঝুঁকি বাড়ায়।
ফলে উদ্ভব হয় ডিডলারাইজেশন প্রবণতা—যেখানে দেশগুলো নিজেদের মধ্যকার লেনদেন ধীরে ধীরে অন্য মুদ্রায় চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলো।
ঋণ ও ঘাটতির বেড়াজালে যুক্তরাষ্ট্র
ট্রাম্প প্রশাসনের খরচ-সর্বস্ব বাজেট পরিকল্পনার কারণে:
-
আগামী এক দশকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হতে পারে,
-
ট্রেজারিতে ঋণের ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে।
এদিকে যাঁদের কাছ থেকে এই ঋণ নেওয়া হবে, তাঁরাই মার্কিন সম্পদ থেকে সরে যাচ্ছেন, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকেত।
ডলার কি আর নিরাপদ আশ্রয়?
ঐতিহাসিকভাবে, বৈশ্বিক অস্থিরতার সময়ে ডলারকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিনিয়োগে আস্থার ঘাটতি—এই তিন মিলেই ডলারকে সেই অবস্থান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সম্পূর্ণ ডিডলারাইজেশন এখনই সম্ভব নয়, তবে শুরুটা হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন—বিশ্ব কি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকল্প প্রস্তুত করছে?
সংক্ষিপ্ত চিত্র:
-
ডলার মূল্য হ্রাস: >১০% (৬ মাসে)
-
সর্বশেষ বড় পতন: ১৯৭৩
-
মূল কারণ: ট্রাম্পের শুল্কনীতি, ঋণ, মূল্যস্ফীতি, ডিডলারাইজেশন
-
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: ডলারের বিকল্পে ঝুঁকছে দেশগুলো
-
মার্কিন অর্থনীতি: উচ্চ ঘাটতি ও বিনিয়োগ আস্থার সংকট
উপসংহার:
বিশ্বমুদ্রা হিসেবে ডলারের শ্রেষ্ঠত্ব এখন প্রশ্নের মুখে। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যদি ‘বহুমুদ্রাভিত্তিক ব্যবস্থার’ সূচনা হয়, তবে ইতিহাসে ২০২৫ সালকে একটি মোড় ঘোরানো বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে।