প্রকাশিত: ঢাকা, সোমবার
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে আশাবাদী মন্তব্য করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। চলতি বছরের মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপস্থিতিতে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, রোহিঙ্গারা আসন্ন ঈদুল ফিতর নিজ দেশে—মিয়ানমারে—পালন করবে। কিন্তু সেই আশাবাদ বাস্তবায়ন তো দূরে থাক, গত পাঁচ মাসে বাংলাদেশে নতুন করে সোয়া লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। সীমান্তের ওপারেই অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আরও ২৫-৩০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে শরণার্থী সংক্রান্ত সংস্থাগুলোর তথ্যে উঠে এসেছে।
আট বছরের অচলাবস্থা
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর থেকে জাতিসংঘ, আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং চীনের মধ্যস্থতায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও স্বেচ্ছায় ফেরত পাঠানো যায়নি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ১,১০০ জনকে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাব
কক্সবাজারে আয়োজিত সাম্প্রতিক এক ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ’-এ মুহাম্মদ ইউনূস সাত দফা প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে ছিল—
-
দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য রোডম্যাপ তৈরি
-
আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা অব্যাহত রাখা
-
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতায় আসিয়ানের তৎপরতা বাড়ানো
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সংকটের সূত্রপাত মিয়ানমারে, তাই সমাধানও হতে হবে সেখানেই।”
রাখাইনের বাস্তবতা
রোহিঙ্গাদের জন্য প্রত্যাবাসনের প্রধান অন্তরায় হলো নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশই বর্তমানে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। রাজধানী সিত্তে ও চকপিউয়ের মতো কৌশলগত অঞ্চল জান্তার হাতে থাকলেও সীমান্তঘেঁষা অন্তত ১৪ টাউনশিপ দখলে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে বিদ্রোহী দমনে—যা তাদের ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করছে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থের টানাপোড়েন
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সমাধান সরল নয়। রাখাইন রাজ্যে ভারত ও চীনের বিপুল অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
-
ভারতের কালাদান প্রজেক্ট: কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।
-
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প: চকপিউ এলাকায় মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্প।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানাচ্ছে, যদি আরাকান আর্মি সমুদ্রবন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়, তবে চীন ও ভারতকে বাধ্য হয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গেই সমঝোতায় বসতে হবে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ পাশ করে মিয়ানমার সেনাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মূল উদ্দেশ্য মানবাধিকার রক্ষা হলেও বাস্তবে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অঞ্চলে ভারত-চীনের প্রভাব মোকাবিলাই প্রধান লক্ষ্য।
পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান
সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের ১১ দেশ (যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি প্রমুখ) যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুতির মূল কারণ সমাধান জরুরি এবং এর জন্য শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল মিয়ানমার অপরিহার্য। তবে কে এই পরিবেশ তৈরি করবে—সে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
জনসংখ্যা ও সামাজিক চাপ
বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। প্রতি বছর শরণার্থী শিবিরে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৩২ হাজার নবজাতক। যদি প্রত্যাবাসন কার্যকর না হয়, আগামী দুই দশকে এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং তা কক্সবাজারসহ সমগ্র দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে—তা এখনই বড় উদ্বেগের বিষয়।
👉 বিশ্লেষণ: রোহিঙ্গা সংকট আর শুধু একটি মানবিক সংকট নয়; এটি এখন আঞ্চলিক ভূরাজনীতি, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বন্দ্বে জটিল এক গ্লোবাল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে গেলেও সমাধান নির্ভর করছে রাখাইন রাজ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বিশ্বশক্তির ভূমিকায়।