মঙ্গলবার, ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

প্রকাশের তারিখ: ২৩ অক্টোবর ২০২৫

প্রতিবেদক: প্রবাস বুলেটিন ডেস্ক


চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চরম চাপের মুখে পড়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ, রপ্তানি আয় কমেছে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছুঁয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকার নতুন রেকর্ড

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা এবং আইএমএফ ঋণের কিস্তি অনিশ্চয়তা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।


🔹 সরকার বদলের পর অর্থনীতিতে ধস

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন।
অন্তর্বর্তী সরকার ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনীতি গড়ার প্রত্যয়’ নিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করলেও তিন মাসের মধ্যেই তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

প্রবৃদ্ধি সহায়ক না হয়ে বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করা সেই বাজেট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে, যা দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন (কোভিডকাল বাদে)।


🔹 মূল্যস্ফীতি ও রপ্তানিতে বিপর্যয়

সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৩৬ শতাংশে, যা আগস্টে ছিল ৮.২৯ শতাংশ।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭.৬৪ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৮.৯৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, টানা তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিচ্ছে।

একই সঙ্গে, রপ্তানি আয়ও কমেছে ৪.৭৩ শতাংশ।
প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পে বিদেশি অর্ডার কমে যাওয়ায় রপ্তানিতে এই ধস নেমেছে।


🔹 বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা

নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প স্থাপনে ধীরগতি বিনিয়োগ প্রবাহে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে।
এর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, “দুর্বল ব্যবসায়িক পরিবেশ, আইনের শাসনের ঘাটতি ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা শ্রমবাজারে আস্থা কমাচ্ছে।”


🔹 রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যাংকিং সংকট

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা
এনবিআর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৯ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৯১ হাজার ৫ কোটি।

অন্যদিকে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৫ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে— যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
পাঁচটি অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
গ্রাহকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে টাকা হারানোর আতঙ্ক


🔹 দারিদ্র্য ও বেকারত্বে ঊর্ধ্বগতি

তিন বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।
বর্তমানে দেশের ২৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, এবং ১৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমায় নামার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বেকারত্বের হার এখন ৪.৬৩ শতাংশ, বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ

নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।


🔹 আইএমএফ কিস্তি ঝুলে আছে

৪৭০ কোটি ডলারের আইএমএফ ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আটকে গেছে
ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফ–বিশ্বব্যাংক বার্ষিক সম্মেলনে সংস্থাটি জানায়, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত কিস্তির অর্থ ছাড়া হবে না।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদড. আহসান এইচ মনসুর জানান,
“আইএমএফ নিশ্চিত হতে চায় যে আগামী সরকার ঋণের শর্তগুলো মেনে চলবে। তাই কিস্তি স্থগিত রয়েছে।”

আইএমএফ প্রতিনিধি দল আগামী ২৯ অক্টোবর ঢাকায় আসছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ডিসেম্বর শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে কিস্তি ছাড়ের সম্ভাবনা ছিল।


🔹 বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন,

“আমাদের মুদ্রানীতিতে গঠনমূলক পরিবর্তন আনা দরকার। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এতে বিনিয়োগ সংকুচিত হয়, কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। বরং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”


🔹 উপসংহার

রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও আন্তর্জাতিক ঋণপ্রবাহে অনিশ্চয়তা— তিন দিকের এই চাপ দেশের অর্থনীতিকে এক গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে এখনই কাঠামোগত সংস্কার ও আস্থা পুনর্গঠন প্রয়োজন, নইলে অর্থনীতি আরও গভীর মন্দার দিকে যেতে পারে।


সূত্র: এনবিআর, বিবিএস, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রতিনিধি দল ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা

Leave A Reply

বৈদেশিক কর্মসংস্থান, অভিবাস ও প্রবাস জীবন সংক্রান্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল।

যোগাযোগ

সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্স (১১তম ফ্লো), রুম ১২/৮, ৬৭, নয়াপল্টন, ভিআইপি রোড, ঢাকা-১০০০, ফোন: +৮৮০ ১৫৩৩-১৯০৩৭১, ইমেইল: info@probashbulletin.com

Exit mobile version