ঢাকা, ১৫ মে ২০২৫:
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ঋণচুক্তির শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে বাজারমুখী নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের হার ব্যাংক ও গ্রাহকদের আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। তবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণহীন না রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, অস্বাভাবিক দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে থাকবে কঠোর নজরদারি।
বাজারমুখী বিনিময় হার: নতুন দিগন্তে প্রবেশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বাজারভিত্তিক মানে এই নয় যে ডলার যেকোনো দামে বিক্রি হবে। যৌক্তিক ও পূর্বাভাসনির্ভর দামে লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে।”
এই নতুন ব্যবস্থায়, ব্যাংকগুলো দিনে দুইবার বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের ডলার কেনা-বেচার তথ্য জানাবে এবং বাজার মূল্য প্রকাশে সহায়তা করবে। ১ লাখ ডলারের বেশি লেনদেন হলে তা সকাল ১১:৩০ এর মধ্যে জানাতে হবে।
সিন্ডিকেট দমনে জিরো টলারেন্স নীতি
গভর্নর জানান, ডলারের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা বরদাশত করা হবে না। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে। ইতিমধ্যে ৫০ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে, যা অতীব জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে।
‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির সূচনা
বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নামক একটি সীমিত হস্তক্ষেপভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এতে প্রতি ডলারের মূল্য ১১৯ টাকার ভিত্তিতে ±২.৫% ওঠানামা করতে পারবে। এর ফলে ডলার কেনা-বেচা এখন ১২৩ টাকার আশেপাশে হচ্ছে, যদিও খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকায়।
ব্যাংকগুলোর তদারকি ও নির্দেশনা
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠকে বসে, যেখানে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয় যেন বর্তমান বিনিময় হারের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য না হয়। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে তদারকি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাজারে স্বস্তি ফিরছে
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারকে একটি রেফারেন্স দেবে। ব্যাংকগুলোকে নিজ নিজ বিচারে দাম নির্ধারণ করতে হবে। বাজার স্থিতিশীল থাকায় দাম নিয়েও খুব বেশি চাপ নেই।”
রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবণতা
বর্তমানে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে এবং মোট রিজার্ভ ২৫ বিলিয়নের বেশি। চলতি অর্থবছরের সাড়ে ১০ মাসে প্রবাসীরা প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে।
আইএমএফের প্রশংসা ও প্রত্যাশা
আইএমএফ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থাকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে এর বাস্তবায়নে জোর দেন। তিনি বলেন, “বিনিময় হারের নমনীয়তা এবং রিজার্ভ শক্তিশালী করা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও স্থিতিশীল করবে।”
উপসংহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক নতুন দিকচিহ্ন। যদিও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, এই পরিবর্তন কতটা স্থায়ী ও কার্যকর হবে, তবে শুরুটা আশা জাগানিয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত তদারকি, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও বৈদেশিক ঋণের ধারাবাহিকতা মিলে দেশের মুদ্রানীতিতে নতুন স্থিতি আনবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।